‘আমরা গরিব বলে কি কোনো বিচার পাব না’

পঞ্চগড় জেলার মানচিত্র

‘বাবাকে হারিয়ে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। এখন ছোট দুই ভাই-বোনের পড়াশোনার খরচ চালাব কীভাবে, ভেবে পাচ্ছি না। বোনটাকে নিয়ে পড়েছি আরও দুশ্চিন্তায়। বোনের শ্লীলতাহানির বিচার পাচ্ছি না। এ কারণে বাবাকেও হারাতে হলো। আমরা গরিব বলে কি কোনো বিচার পাব না?’

পঞ্চগড় সদর উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের একটি গ্রামে ‘মেয়ের শ্লীলতাহানির বিচার না পেয়ে’ আত্মহত্যা করেন এক বাবা (৫০)। তাঁর বড় ছেলে (২৭) কথাগুলো বলছিলেন।
গত বুধবার রাতে বাড়ির অদূরে গাছের ডালে গলায় চাদর প্যাঁচানো ঝুলন্ত লাশ দেখে পুলিশকে খবর দেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

খবর পেয়ে রাতেই আটোয়ারী থানা–পুলিশের সহায়তায় পঞ্চগড় সদর থানার পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। পরে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে লাশ ময়নাতদন্তের পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ।

পরিবারের দাবি, কলেজছাত্রী (২০) মেয়ের শ্লীলতাহানির ঘটনায় ইউনিয়ন পরিষদে বিচার দিয়েছিলেন ওই বাবা। বিচার না পেয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।

আজ শনিবার দুপুরে মাগুরা ইউনিয়নের ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। এর মধ্যে ব্রাহ্মণ ডেকে মারা যাওয়া ব্যক্তির শ্রাদ্ধের আয়োজন চলছে। স্বজনেরা বলেন, ১৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় পলাশ চন্দ্র বর্মণ (২৫) নামের এক প্রতিবেশী তরুণ ওই কলেজছাত্রীর শ্লীলতাহানি করেন। এ ঘটনায় ওই তরুণী আহত হন। পরে তাঁকে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ভুক্তভোগী পরিবার ও পুলিশ সূত্র জানায়, এ ঘটনায় শুক্রবার রাতে ওই তরুণীর বড় ভাই বাদী হয়ে পলাশ চন্দ্র বর্মণসহ চারজনকে আসামি করে পঞ্চগড় সদর থানায় ধর্ষণ ও আটোয়ারী থানায় আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা করেন। মামলায় মাগুরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জ্যোতিষ চন্দ্র রায়ের নাম ‍উল্লেখ না করলেও শ্লীলতাহানির ঘটনার বিচারে তাঁর অসহযোগিতার কথা এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) রাকিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি আটোয়ারী থানা এলাকায় হওয়ায় ওই থানায় আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা হয়েছে। আর ধর্ষণের মামলাটি হয়েছে সদর থানায়। দুটি মামলাই আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’

পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া আধা বিঘা জমিতে চার ভাইয়ের পরিবার নিয়ে বাস। নিজের এক বিঘা আবাদি জমিসহ প্রতিবেশীদের জমি বর্গা নিয়ে কৃষিকাজ করতেন মারা যাওয়া ব্যক্তি। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন তিনি। তাঁর বড় ছেলে একটি দোকানে মেকানিকের কাজ করেন। মেয়েটি একটি কলেজে সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ছোট ছেলে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে।

মারা যাওয়া ব্যক্তির ভাই প্রথম আলোকে বলেন, ‘বুধবার সন্ধ্যায় আমার ভাতিজির শ্লীলতাহানি করে পলাশ। এ ঘটনার বিচার চেয়ে মাগুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জ্যোতিষ চন্দ্র রায়কে মৌখিকভাবে আমরা জানাই। এমনকি আমার ভাইসহ চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে তাঁর হাত পর্যন্ত ধরি। তিনি আশ্বাস দিয়ে ধৈর্য ধরতে বলেন। পরে ২৪ জানুয়ারি চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু চেয়ারম্যান পলাশকে হাজির না করেই শুধু অভিভাবকদের নিয়ে বসতে চান। এদিকে পলাশের পরিবার ও আশপাশের লোকজন এটা নিয়ে আমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে থাকে। বিচার না পেয়ে ও আশপাশের লোকজনের কথা শুনে লজ্জায় আমার ভাই আত্মহত্যা করেছেন।’

মারা যাওয়া ব্যক্তির বড় ছেলে বলেন, ‘পলাশ আমার বোনকে ধর্ষণ করে। এরপর “আমরা তাদের কিছুই করতে পারব না” বলে এলাকায় সবার কাছে দম্ভ করে বেড়াচ্ছিল। আমরা গরিব হওয়ায় তারা আমাদের নিয়ে তাচ্ছিল্য করছিল। এদিকে চেয়ারম্যান তাকে হাজির করে বিচারও করছিলেন না। এসব কষ্টে আমার বাবা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। আমার বোনের ধর্ষণকারী ও বাবার আত্মহত্যার প্ররোচনাকারীদের বিচার চাই আমি।’