ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় কক্ষে কক্ষে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মারধর

রাজশাহী কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে সাধারণ ছাত্র নির্যাতনের পরে অধ্যক্ষের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিতণ্ডা। বুধবার দিবাগত রাত ১২টায় ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহী কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে ২ জন শিক্ষানবিশ সংবাদকর্মীসহ অন্তত ৩০ শিক্ষার্থীকে মারধর, নির্যাতন ও গালাগালের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যোগ না দেওয়ায় গতকাল বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে ছাত্রাবাসের কক্ষে কক্ষে গিয়ে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

খবর পেয়ে ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রাতে ছাত্রাবাসে উপস্থিত হন কলেজের অধ্যক্ষ ও আরেকজন সহযোগী অধ্যাপক। ছাত্রলীগের কর্মীরা তাঁদের সামনেই শিক্ষার্থীদের ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দেন। দিবাগত রাত প্রায় একটার পর বহিরাগত ব্যক্তিদের বের করে দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন অধ্যক্ষ মোহা. আবদুল খালেক।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, কলেজ ছাত্রাবাসে থাকা শিক্ষার্থীদের জোর করে মিছিল-মিটিং ও দলীয় কর্মসূচিতে নিয়ে যায় ছাত্রলীগ। যেতে না চাইলে মারধরসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা অসুস্থ থাকলেও ছাড় পান না শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া রয়েছে সিট–বাণিজ্যের অভিযোগ।

নির্যাতনে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রাশিক দত্তের অনুসারী। তবে তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে রাশিক দত্ত সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাটা তিনি শুনেছেন। তাঁর ছেলেরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। তাঁদেরও তো রাজনীতি করতে হয়। বিভিন্ন সংগঠনের ৪ থেকে ৫ জন করে যদি ২০ জন ছেলে চলে যায়, তাহলে তাঁরা কীভাবে অনুষ্ঠানটা চালাবেন? তবে এর পর থেকে এমন হবে না। তাঁদের সঙ্গে বসে সমঝোতা করে নেবেন।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল বিকেলে ছাত্রলীগের একটি কর্মসূচি ছিল। ওই কর্মসূচিতে না যাওয়ায় সন্ধ্যার পর ছাত্রাবাসের ই ব্লক ও বি ব্লকের বিভিন্ন কক্ষে ঢুকে শিক্ষার্থীদের মারধর শুরু করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। মারধরের শিকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব ও শরীফুল ইসলামও রয়েছেন। তাঁরা ক্যাম্পাসে কর্মরত সাংবাদিকের সংগঠন রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির (আরসিআরইউ) সদস্য।

নাজমুস সাকিব বলেন, ছাত্রলীগের কর্মীরা বিভিন্ন সময় তাঁদের দলীয় কর্মসূচিতে জোর করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে যান। গতকাল বিকেলেও ছাত্রলীগের একটা কর্মসূচিতে যেতে হয়। সেখান থেকে অসুস্থতার জন্য মেডিকেলে যেতে চাইলেও ছাত্রলীগ নেতা রাফি (কর্মসূচির আহ্বায়ক) তাঁকে ছাত্রাবাস ছেড়ে দিতে বলেন। তাঁকে কোনোরকমে বুঝিয়ে তিনি মেডিকেলে যান। সেখান থেকে সন্ধ্যা ছয়টায় ছাত্রাবাসে ফিরলে ছাত্রলীগের শাহরুখ, রাজু, রাফি, হাসানসহ ৮ থেকে ১০ জন মিলে তাঁর কক্ষে ঢুকে মারধর করতে থাকেন।

নাজমুস সাকিব আরও বলেন, তাঁর মুঠোফোনসহ বেশ কিছু দামি জিনিস কেড়ে নেওয়া হয়। একপর্যায়ে সব শিক্ষার্থীকে ব্লকে আটকে রেখে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করতে থাকেন, অনেককে মারধরও করেন। পরে সবাইকে ধাক্কা দিতে দিতে গণরুমে নিয়ে যান। সেখানে শাসানো হয়, কারও কাছে কিছু বললে আরও ভয়ানক কিছু ঘটবে।

আরেক ভুক্তভোগী শরিফুল ইসলাম বলেন, গতকাল সকাল সাড়ে নয়টায় ব্যক্তিগত কাজে ছাত্রাবাস থেকে বের হয়ে যান। সারা দিন ব্যস্ত ছিলেন। সন্ধ্যায় রুমে ঢুকে সংবাদ লিখছিলেন। এমন সময় হঠাৎ রাশিক দত্তের কর্মী শাহরুখ রুমে ঢুকে পড়েন। কিছু না জিজ্ঞাসা করেই অতর্কিত মারতে থাকেন। সাংবাদিক পরিচয় দিলে আরও মারতে শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে আরও ছেলেরা এসে তাঁকে মেরে কক্ষ থেকে বের করে দেন। বকাবকি ও ধাক্কাধাক্কি করেন।

সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভয়ে নির্যাতনের বিষয়ে মুখ খুলতে চাইছেন না। নাম প্রকাশ না করে এক শিক্ষার্থী বলেছেন, ‘ঘটনার পরে শাসিয়ে ছাত্রলীগ কলেজ শাখার সভাপতি রাশিক দত্ত বলেছেন, ‘যা–ই করো, ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে নিয়মিত উপস্থিত থাকা লাগবে, না হলে হোস্টেল থেকে বের করে দেব।’ ওই ছাত্রের অভিযোগ, এর আগেও অনেকবার মা-বাবা তুলে গালিগালাজ ও বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অভিযোগ পেয়ে গতকাল রাতে সাংবাদিক, কলেজ ফাঁড়ির পুলিশসহ কলেজ অধ্যক্ষ মোহা. আবদুল খালেক ও কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছাত্রাবাসে যান। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা অধ্যক্ষের সামনেই দুই সাংবাদিককে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এ সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষের কাছে তাঁদের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন। তখন ছাত্রাবাসে ব্যাপক ভিড় হয়। রাতে প্রায় ১২টার দিকে তিনজন বহিরাগত ব্যক্তি এক মোটরসাইকেলে ছাত্রাবাসে ঢোকেন। সে সময় অধ্যক্ষ একজন ছাত্রলীগ কর্মীর সঙ্গে ছাত্র নির্যাতনের বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন। একজন বহিরাগত অধ্যক্ষের সামনে থেকে ওই ছাত্রলীগ কর্মীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। অধ্যক্ষ ও শিক্ষক আনিছুজ্জামান তাঁদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জানতে চান, কেন তাঁরা এত রাতে ছাত্রাবাসে ঢুকেছেন? তাঁরা নিজেদের ছাত্রলীগের বড় ভাই দাবি করেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের বের করে দেওয়া হয়। তখন রাত প্রায় একটা বেজে যায়। একজন ছাত্রলীগ নেতা অধ্যক্ষকে বলেন, তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি থাকতে ওই দুই ছাত্রের গায়ে একটা ফুলের টোকাও কেউ দেবে না। অধ্যক্ষ তখন বলেন, সব সাধারণ ছাত্রেরই দায়িত্ব নিতে হবে। তাঁদের যেন কিছু না হয়।

কলেজ অধ্যক্ষ মোহা. আবদুল খালেক রাত একটায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিস্থিতি এখন শান্ত। ওরা হুমকি দিলেও আর কিছু করতে পারবে না। ওসব কিছু ঘটবে না।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূর মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, ঘটনাটি তিনি শুনেছিলেন। বিস্তারিত জানে না। শুনে পরে জানাবেন।

দায়িত্বে আসার আগে থেকেই নানা অপকর্মে সমালোচিত হন রাশিক দত্ত। এর আগে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে রিপোর্টার্স ইউনিটির কার্যালয়ে হামলা চালান রাশিক দত্তের অনুসারী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। দেড় বছর নেতৃত্বহীন থাকার পর গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর কলেজ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসেন রাশিক দত্ত ও আশরাফুল ইসলাম।

সম্প্রতি কলেজ হোস্টেলের কক্ষে মাদক সেবনের ভিডিও ভাইরাল হলে আবারও আলোচনায় আসেন রাশিক দত্ত, যা গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়েছে। এ ছাড়া সালাম না দেওয়া, দেখে না দাঁড়ানো, মিছিলে না আসা, প্রোগ্রামে না যাওয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনায় ক্যাম্পাসে ও হোস্টেলে একাধিক শিক্ষার্থীকে মারধর করেন বলে রাশিক দত্ত ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।