সাজা ছাড়াই যেভাবে ৩০ বছর কারাগারে ছিলেন কানু মিয়া
কোনো ধরনের সাজা ছাড়াই হবিগঞ্জের কানু মিয়ার ৩০ বছর কারাভোগ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। সবার প্রশ্ন, বিচার ছাড়াই তিনি এত বছর কীভাবে কারাগারে বন্দী থাকলেন। এ ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষ, আইন ও পুলিশ বিভাগ দায় এড়াতে পারে না বলে মনে করেন আইনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কানু মিয়ার বাড়ি হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার সিংহ গ্রামে। ১৯৯৫ সালে মাকে হত্যার অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হন। ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ থাকায় ২০০৩ সালে হত্যা মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে তাঁকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু তাঁকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়নি। এর পর থেকে তিনি কারাগারে ছিলেন। সম্প্রতি বিষয়টি জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তার নজরে এলে আদালতের নির্দেশে গত মঙ্গলবার দুপুরে তিনি কারামুক্ত হন। বর্তমানে তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে আছেন।
মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মামলার বাদী ছিলেন কানু মিয়ার বড় ভাই মনু মিয়া। তিনি আরজিতে উল্লেখ করেন, তাঁর ভাই একজন মানসিক রোগী। ঘুমের ঘোরে কোদাল দিয়ে মাকে হত্যা করেছেন। পুলিশ ১৯৯৬ সালের ২৩ মার্চ কানু মিয়াকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এতে তৎকালীন উপপরিদর্শক গোলাম সরোয়ার উল্লেখ করেন, ঘটনা তদন্তে কানু মিয়া মানসিক রোগী হিসেবে প্রকাশ পায়। যে কারণে আসামি কানু মিয়া তাঁর মাকে হত্যা করেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আদালত মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত করেন। সেদিন আদেশে উল্লেখ করা হয়, জেল সুপার ও কারা কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আসামি কানু মিয়া সম্পূর্ণ একজন পাগল। এমতাবস্থায় তাঁকে জেলহাজতে রাখা সমীচীন নয় বলে আদালত মনে করছেন। তাই আসামিকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য পাঠানোর জন্য জেল সুপারকে নির্দেশ দেওয়া হলো। তবে আদালতের নির্দেশ প্রতিপালন করেনি কারা কর্তৃপক্ষ।
নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কানু মিয়াকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে না পাঠিয়ে সিলেট কারাগারে পাঠানো হয়। সিলেট কারাগার কর্তৃপক্ষ নানা সময় কানু মিয়াকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে আবার হবিগঞ্জ কারাগারে পাঠায়। কানু মিয়া যে একজন মানসিক রোগী, এ বিষয়ে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতামত নেই। এভাবে বছরের পর বছর পার হয়ে যায়। এর মধ্যে ২০১৯ সালে জেলা জজ আদালতের এক বিচারক কানু মিয়ার চিকিৎসার অগ্রগতি জানতে চাইলে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁর অবস্থার পরিবর্তন হয়নি বলে উল্লেখ করে।
একসময় কানু মিয়াকে আইনগত সহায়তা দিয়েছিলেন আইনজীবী সফিকুর রহমান চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আদালত স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন, কানু মিয়াকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দিতে। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ সেই কাজ করেনি। তারা আদালতকে তথ্য দিয়েও সহযোগিতা করেনি। এখানে পুলিশের দায়িত্ব ছিল, কানু মিয়ার সার্বিক বিষয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা; কিন্তু তারা দায়সারা প্রতিবেদন দিয়ে ঘটনাটি আরও জটিল করেছে।
জানতে চাইলে হবিগঞ্জ জেলা কারাগারের জেল সুপার মো. মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা তাঁর চিকিৎসা করিয়েছি। তাঁকে দুবার পাবনা এবং পরে বেশ কয়েকবার সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের মানসিক বিভাগে চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু চিকিৎসকেরা ব্যবস্থাপত্র দিয়ে তাঁকে ফেরত পাঠিয়ে দেন।’
আদালতের নির্দেশনা ছিল, কানু মিয়া সুস্থ হওয়ার আগপর্যন্ত পাবনা মানসিক হাসপাতালে থাকবেন, তাহলে সুস্থ হওয়ার আগে কেন কারাগারে আনা হলো, জানতে চাইলে জেল সুপার বলেন, ‘চিকিৎসকেরা কেন ফেরত দিলেন, তাঁরাই ভালো বলতে পারেন।’ পাবনায় চিকিৎসা করানোর তথ্য আদালতের নথিতে নেই কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই নথি শুধু আমাদের কাছে আছে, তা আদালতের কাছে নেই।’
জেলা জজ আদালতের নাজির সেলিনা বেগম বলেন, কানু মিয়ার জামিনের বিষয়ে আদালতের সম্মতি ছিল, কিন্তু জামিনদার পাওয়া যায়নি। একজন সুস্থ মানুষকে জামিন দিলেও জামিনদার লাগে। কানু মিয়ার পরিবারের সদস্যদের জামিনের বিষয়ে একাধিকবার খোঁজ করেও পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে কানু মিয়ার ভাই নাসু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তিন থেকে চার দিন আগে হবিগঞ্জ আদালতের এক আইনজীবীসহ দুজন মানুষ তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন তাঁরা জানতে পারেন, তাঁর ভাই কানু মিয়া এখনো বেঁচে আছেন। কয়েক বছর আগে ভাইকে কারাগারে দেখতে গিয়েও খোঁজ পাননি। তখন একজন সিলেটে থাকার কথা বলেছিলেন। কিন্তু গরিব হওয়ায় তাঁরা সিলেটে যাননি। তিনি বলেন, আদালতের নির্দেশে মামলা স্থগিত আছে বা তাঁর ভাইয়ের চিকিৎসার প্রয়োজন, এই তথ্য কেউ তাঁদের দেয়নি। তাঁরা যদি জানতেন, জামিনদার পেলে ভাইয়ের জামিন হবে, তাহলে অনেক আগেই আদালতের সাহায্য নিতেন।