সুনামগঞ্জে গ্রেপ্তারের সময় মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ
সুনামগঞ্জে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের সময় রমিজ মিয়া (৫০) নামে এক আসামির মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন আদালত। এ বিষয়ে কোনো মামলা বা আইনি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না, পুলিশের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। ২৯ এপ্রিল রমিজ মিয়ার লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনের অনুলিপিসহ এ বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য তাহিরপুর থানা-পুলিশকে আদেশ দিয়েছেন আদালত।
সুনামগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (তাহিরপুর আমল গ্রহণকারী আদালত) আবদুল হালিম এই আদেশ দিয়েছেন। আদেশে ১৮ এপ্রিল প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, ১৮ এপ্রিল প্রথম আলোর ৬ নম্বর পৃষ্ঠার ৫ নম্বর কলামে ‘গ্রেপ্তারের সময় মারধরে আসামির মৃত্যু অভিযোগ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন আদালতের গোচরীভূত হয়েছে। এরপর প্রকাশিত পুরো প্রতিবেদনটি উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে স্থানীয় দুটি পত্রিকায় প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত সংবাদের কথাও বলা হয়েছে।
আদালত আদেশে বলেন, প্রতিবেদনগুলোয় লেখা ঘটনা পর্যালোচনা করে আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটিত হতে পারে বলে সন্দেহের কারণ আছে। এটি তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এ ঘটনায় তাহিরপুর থানায় কোনো মামলা হয়েছে কি না, কিংবা কোনো আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে কি না, সেটি নিহত ব্যক্তির সুরতহাল প্রতিবেদনের ফটোকপিসহ আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন আকারে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। আদেশের কপি জেলা ও দায়রা জজ, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারের কাছেও পাঠানো হয়েছে।
১৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের বুরুঙ্গামারা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় টেকেরঘাট পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের দুজন সদস্য রমিজ মিয়াকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিলেন। রমিজ মিয়ার বিরুদ্ধে একটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল বলে পুলিশ জানায়।
রমিজ মিয়ার ছেলে সাইফুল ইসলাম (২২) প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘সবকিছু আমার চোখের সামনে ঘটেছে। পুলিশের বেধড়ক মারধরেই বাবা মারা গেছেন। আমরা গরিব মানুষ। দিন আনি দিন খাই। শহরে গিয়ে বিচার চাইব, এই সামর্থ্যও নাই।’
সাইফুল ইসলাম জানান, বুরুঙ্গামারা গ্রামের রাস্তার পাশেই তাঁদের ঘর। বসতঘরের সামনের অংশে চায়ের দোকান। তাঁর বাবা দোকান চালান। তাঁরা দুই ভাই। দুজনই শ্রমিক। কাজ না থাকলে বাবার সঙ্গে দোকানে বসেন। ঘটনার দিন বিকেলেও দোকানে রমিজ মিয়ার সঙ্গে সাইফুল ছিলেন। তাঁর ভাষ্য, বিকেলে দুজন লোক একটি মোটরসাইকেলে এসে তাঁদের দোকানের সামনে নামেন। একজন দোকানে ঢুকে সিগারেট চান। সাইফুল ড্রয়ার থেকে সিগারেট বের করার সময় ওই ব্যক্তি তাঁর বাবার নাম জিজ্ঞেস করেন। রমিজ মিয়া নাম বলতেই তাঁকে বুকে ঘুষির মতো ঝাপটা দিয়ে ধরেন। এ সময় সাইফুল ওই ব্যক্তিকে ধরার চেষ্টা করলেই তাঁরা পুলিশ পরিচয় দেন এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে বলে জানান। পরোয়ানার কাগজ দেখতে চাইলে তাঁরা জানান, ফাঁড়িতে আছে। তখন রমিজ মিয়া ঘরের ভেতর থেকে মামলার কাগজপত্র এনে দেখানোর কথা বলেন। কিন্তু তাঁকে যেতে না দিয়ে আরও জোরে ধরা হয়। একপর্যায়ে ধস্তাধস্তি করে রমিজ মিয়া নিজেকে ছাড়িয়ে ঘরের পেছন দিকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। তখন পুলিশের একজন দোকানে থাকা একটি নারকেলগাছের ডাল দিয়ে তাঁকে সজোরে আঘাত করেন। তিনি ঘরের পেছনের দিকে হাত বিশেক দূরে আরেক বাড়িতে গিয়ে ওঠেন।
পুলিশ সদস্যরাও সেখানে যান এবং রমিজ মিয়াকে আবার ধরে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি মারেন। তাঁর গলায় চেপে ধরে ওই ঘরের দেয়ালে কয়েকবার ধাক্কা দেওয়া হয়। তখন সাইফুল বাবাকে রক্ষা করার জন্য কান্নাকাটি শুরু করেন। রমিজ মিয়া আবারও কোনোরকমে তাঁদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সামনে যাওয়ার সময় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন তাঁর নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। গ্রামের লোকজন জড়ো হলে পুলিশ সদস্যরা দ্রুত সেখান থেকে চলে যান। এর কয়েক মিনিট পরই তিনি মারা যান।
পুলিশের ভাষ্য, রমিজ মিয়া শ্বাসকষ্টের রোগী ছিলেন। তিনি দৌড়ে পালিয়ে গ্রামের অন্য এক বাড়িতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। পুলিশ তাঁকে মারধর করেনি।
রমিজ মিয়াকে ধরতে যাওয়া টেকেরঘাট পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) জিয়াউর রহমানও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘উনি (রমিজ) দোকান থেকে পালানোর পর আমরা তাঁকে আর ধরতে পারিনি। কিছু সময় খোঁজাখুঁজি করে পরে আমরা চলে আসি।’
তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালত ঘটনার বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। পুলিশ ঘটনাটি খতিয়ে দেখছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের কারও অবহেলা বা ত্রুটি থাকলে সেটিও আমরা দেখব।’