‘একটা শব্দ শুনলাম, পরে দেখলাম চোখের সামনে পুরা দোকান ধসে পড়ছে’

বিআরটি প্রকল্পের ক্রেনটি উল্টে রাস্তার পাশের দোকানের ওপর পড়ে। শনিবার বিকেলে টঙ্গীর মন্নুগেট এলাকায়ছবি: সংগৃহীত

রাস্তার পাশে সারি সারি কয়েকটি দোকান। এর মধ্যে একটি দোকানে পাইকারি মালামাল বিক্রি করেন আনোয়ার হোসেন। গতকাল শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আনোয়ারের দোকানে ছয় থেকে সাতজন ক্রেতা ছিলেন। এর মধ্যেই হঠাৎ বিকট শব্দে দোকানের ওপর কিছু একটা ধসে পড়ে। আনোয়ারসহ দোকানে থাকা সবাই তড়িঘড়ি বেরিয়ে দেখেন, বিআরটির প্রকল্পের বিশাল এক ক্রেন উল্টে দোকানের ওপর পড়েছে। এতে টিনের আঁচর কিংবা দেয়ালের আঘাতে কেউ কেউ আহত হয়েছেন। তবে ভাগ্যের জোরে যেন এ যাত্রায় সবাই বেঁচে যান।

গতকাল বিকেলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গীর মন্নুগেট এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। বিআরটি প্রকল্পের উড়ালসড়কের রড উঠাতে গিয়ে একটি ক্রেন হঠাৎ রাস্তার পাশের কয়েকটি দোকানের ওপর উল্টে পড়ে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চারটি দোকান ও একটি বসতঘরের অবকাঠামো ও মালামাল। তবে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যায় কয়েকটি প্রাণ।

আজ রোববার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত দোকানগুলো টঙ্গী মন্নুগেট এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কর পূর্ব পাশে। গতকাল ক্রেন উল্টে পড়ার পর থেকেই দোকানিরা নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। রাত জেগে অনেকেই দোকানের মালামাল পাহারা দিয়েছেন। দোকানগুলো পড়ে আছে ভাঙা অবস্থায়। কোনো দোকানের দেয়াল ধসে পড়েছে। কোনোটির টিন দুমড়েমুচড়ে গেছে।

ঘটনাস্থলে গিয়ে কথা হয় ক্ষতিগ্রস্ত দোকানি আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত আরও কয়েকজন দোকানি রাস্তার পাশে মন খারাপ করে বসেছিলেন। আনোয়ার তাঁর দোকানে জুস, কোমল পানীয় পাইকারি মূল্যে বিক্রি করেন। প্রতিদিন বিকেলে বিভিন্ন এলাকার খুচরা ক্রেতারা তাঁর কাছে মালামাল কিনতে আসেন। গতকালও দোকানভর্তি লোকজন ছিল। কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ করে ক্রেন উল্টে পড়ে তাঁর দোকানে। এতে ভেঙে যায় পুরো দোকান।

আনোয়ার বলেন, ‘আমরা কীভাবে বেঁচে আছি, নিজেরাই জানি না। খালি একটা শব্দ শুনলাম। পরে দেখলাম চোখের সামনে পুরা দোকান ধসে পড়ছে। এর মধ্যেই আমরা কোনোরকম ভাগ্যের জোরে বেঁচে রইলাম। তবে অনেকেই আঘাত পেয়েছেন। হাত-পা কেটে গেছে।’  

আনোয়ারের দোকান ছাড়াও ক্রেনের আঘাতে আরও তিনটি দোকান ও বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে আহত হয়েছেন স্থানীয় মো. জামাল হোসেন, দেলোয়ারসহ আরও কয়েকজন। আহত ব্যক্তিদের কেউ কেউ হাত–পা, আবার কেউ ঘাড়ে ব্যথা পেয়েছেন। তবে কেউ গুরুতর আহত হননি। ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিদের অভিযোগ, প্রকল্পের কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। কাজের সময় ক্রেনটি ঠিকমতো মাটিতে বসানো হয়নি। এ জন্য রডের মতো ভারি মালামাল উঠানোর সময় ক্রেনটি উল্টে পড়েছে বলে দাবি তাঁদের।

বিআরটি প্রকল্পের ক্রেন উল্টে পড়ায় কিছুক্ষণ ঢাকামুখী মহাসড়কের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শনিবার বিকেলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী মন্নুগেট এলাকায়
ছবি: সংগৃহীত

আনোয়ারের দোকানের পাশেই ‘পলি স্টোর’ নামে একটি মুদিদোকান আছে। দোকানি রওশন ও তাঁর আট বছর বয়সী ছেলে দীন মোহাম্মদ গতকাল দোকানে বসে ছিলেন। এর মধ্যে ক্রেনের একাংশ উল্টে পড়ে তাঁর দোকানে। এ সময় দোকানের একটি দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে দীন মোহাম্মদ। দেয়ালের আঘাতে দীন মোহাম্মদের বাম হাতের দুই আঙুল ভেঙে গেছে। এ ছাড়া মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত পেয়েছে সে। পরে তাঁকে উদ্ধার করে দ্রুত নেওয়া হয় একটি হাসপাতালে। আজ সকালে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করতে এসে রওশন এসব কথা বলছিলেন।

রওশন বলেন, ‘অল্পের জন্য আমরা বাপ-ছেলে বাইচা গেলাম। আমার দোকানও ভেঙে শেষ। এই ক্ষতি কীভাবে পুষাব, সেটা নিয়েই দিশাহারা দশা। ছেলেটাও হাত নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে।’

দোকানি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রকল্পের লোকজনের গাফিলতির কারণে আমাদের এত বড় ক্ষতি হয়ে গেল। কাজ করার সময় মাটি উঁচুনিচু ছিল। সেখানে ঠিকমতো ক্রেনকে না বসিয়েই মালামাল উঠানো হচ্ছিল। এর মধ্যে রড তুলতে গিয়ে হঠাৎ এ ঘটনা ঘটে। অল্পের জন্য এতগুলো মানুষের জীবন বেঁচে গেছে। আমাদের দোকান ভেঙে শেষ। ব্যবসায়িক চরম ক্ষতি হয়েছে। আমরা এসবের ক্ষতিপূরণ চাই।’

এ বিষয়ে গতকাল বিআরটি প্রকল্পের পরিচালক মহিরুল ইসলাম বলেন, সাধারণত কোথাও ক্রেন দিয়ে কাজ করতে হলে তাঁদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয় বা তাঁদের জানানো হয়। কিন্তু গতকাল ক্রেন দিয়ে কাজ করার ব্যাপারে কোনো কিছু জানানো হয়নি। এ ঘটনায় কারও কোনো গাফিলতি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে জানিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানান। পাশাপাশি আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা বা ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও বিবেচনা করা হবে জানানো হয়।

তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে আজ সকালে পুনরায় যোগাযোগ করা হলে মহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। আমরা ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। তদন্ত চলছে। আশা করছি আজকের মধ্যেই একটা ফল জানাতে পারব।’