এখনো আছে রাজশাহীর সেই শাহী ফিরনি

রাজশাহীর রহমানিয়া হোটেলের এই ফিরনি বিক্রি হচ্ছে ১৯৫২ সাল থেকেছবি: শহীদুল ইসলাম

আদা আর পানি। সামর্থ্যবানেরা আদার সঙ্গে গুড়ের শরবতও খেতেন। তখন সবে শুরু হয়েছে রহমানিয়া হোটেলের শাহি ফিরনি। এই ছিল পঞ্চাশের দশকে রাজশাহীর ইফতারির আয়োজন। ষাটের দশকে এর সঙ্গে যোগ হয় ঘুগনি (ছোলা), পেঁয়াজু আর বেগুনি। সেই আয়োজনের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে অভিজাত হোটেলের হরেক রকম রেসিপি। যার নামের সঙ্গে মানুষ প্রতিদিনই পরিচিত হচ্ছে। তবে অধুনা সব ইফতারসামগ্রীর সঙ্গে সেই ফিরনি এখনো টিকে রয়েছে।

রাজশাহী নগরের আহাম্মদপুর পঞ্চবটী এলাকার একটি অভিজাত পরিবারের গৃহবধূ রিজিয়া সরকারের বয়স এখন ৯৮। সে সময় বাড়িতে কী ধরনের ইফতারের আয়োজন করা হতো, তা বললেন তিনি। তাঁর ভাষায়, তখন ইফতারি কেনার চল ছিল না। পানি আর আদা দিয়ে ইফতার হতো। তারপর খাওয়া হতো রাতের খাবার। তারপর শুরু হলো ঘুগনি, পেঁয়াজু আর বেগুনি। আর বাড়ির গাছের লেবু দিয়ে আখের গুড়ের শরবত দেওয়া হতো। বাড়ির তৈরি ইফতারি মসজিদে দেওয়ার চল ছিল।

গবেষক মাহাবুব সিদ্দিকীর বয়স এখন ৭৫ বছর। তিনি ছোটবেলার ইফতারের স্মৃতি হাতড়ে বললেন আদা, পানি আর শরবতের কথা। বাইরে তখন কোনো ইফতারসামগ্রী এখনকার মতো বিক্রির চল ছিল না। থাকার মধ্যে ছিল রহমানিয়া ও মাজেদিয়া হোটেলের ফিরনি। সেই মাজেদিয়া এখন আর নেই।

গণকপাড়ার মোড়ের রহমানিয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁর সামনে এখনো একশ্রেণির খদ্দেরের ভিড় থাকে। সেখানে ১৯৫২ সাল থেকে মাটির পাত্রে অভিনব ইফতারসামগ্রী পাওয়া যায়। নাম শাহি ফিরনি। আধুনিক সব ইফতারসামগ্রীর পাশে হারিয়ে যায়নি ফিরনি। বুধবার বিকেলে গিয়ে আগের বছরের মতোই সেখানে শাহি ফিরনির উপস্থিতি পাওয়া গেল।

হোটেলের স্বত্বাধিকারী রিয়াজ আহাম্মেদ খান বলেন, ১৯৫২ সালে তাঁর দাদা আনিছুর রহমান খান এই হোটেল প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে তিনি এখানে শাহি ফিরনি বিক্রি চালু করেন। তখন এক বাটি ফিরনির দাম ছিল চার আনা। দাদার মৃত্যুর পর তাঁর বাবা আবদুল বারি খান এই ব্যবসার হাল ধরেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনি এখন এই ব্যবসা দেখাশোনা করছেন। রিয়াজ আহাম্মেদের ভাষ্য অনুযায়ী, শুরু থেকেই প্রতিটি বাটিতে ১০০ গ্রাম করে ফিরনি দেওয়া হয়। এত বছর পরও তাঁরা আসল শাহি ফিরনির মান অটুট রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ইফতারি কেনায় ব্যস্ত ক্রেতারা। রাজশাহী নগরের একটি রেস্তোঁরায়
ছবি: প্রথম আলো

সে জন্য উত্তরোত্তর এর চাহিদা বেড়েই চলেছে। দাম শুধু চার আনা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৫ টাকা। প্রথম রোজায় ৪৭০ বাটি ফিরনি বিক্রি হয়েছে। গতকাল শনিবার ৫০০ বাটি ইফতারি বিক্রির প্রস্তুতি চলছিল। এখন এই রেস্তোরাঁয় ফিরনির পাশাপাশি আয়োজন করা হয়েছে ৩৭ রকমের ইফতারসামগ্রীর। এই দোকানেই পাওয়া গেল নগরের শালকবাগান এলাকার ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনকে। তিনি পরিবারের জন্য তিন বাটি ফিরনি নিয়েছেন। বললেন, প্রতিবছরই রোজায় তিনি শাহি ফিরনি কিনে থাকেন।

বাটার মোড় এলাকার একটি দোকানের কোনো নাম নেই, নেই কোনো সাইনবোর্ড। অথচ নামহীন এই দোকানের সামনেই মানুষের ভিড়। সবাই কিনতে চান এই দোকানের জিলাপি। তাই কড়াই বড় হলেও ভেজে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না কারিগর সাফাত আলী। কড়াই থেকে সরাসরি দাঁড়িপাল্লায় গিয়ে উঠছে জিলাপি। একরকম কাড়াকাড়ি করে ক্রেতারা জিলাপি কিনছেন। সেখানে ৫৭ বছর ধরে জিলাপির রমরমা ব্যবসা। কারিগর সাফাত আলী জিলাপির প্যাঁচ দিতে দিতে বলেন, তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে এই দোকানে জিলাপি ভাজছেন। তাঁর ওস্তাদ কালিপদ ৪৬ বছর এই দোকানের কারিগর ছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই তিনি কাজ শিখেছেন।

নগরের অন্য সব আধুনিক দোকানে সাধারণ জিলাপির পাশাপাশি ইফতারির জন্য তৈরি হচ্ছে রেশমি জিলাপি। এই জিলাপি প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৪০০ টাকা। সেখানে সাধারণ জিলাপি বিক্রি হয় ২০০ টাকা কেজি।

সাহেববাজারে জিরো পয়েন্টের পাশে আরেক শ্রেণির ইফতারসামগ্রীর পসরা নিয়ে বসে চিলিস চায়নিজ রেস্টুরেন্ট। তাদের ইফতারসামগ্রীতে রয়েছে একটু ভিন্নতা। তাদের এবার বিশেষ আকর্ষণ রাশিয়ান চিকেন ফিঙ্গার, এগ ভেজিটেবল পাকুড়া, চিকেন ডোনাট, চিকেন অনথন, চিকেন সালাদ রোল, চিকেন বাটি কাবাব ইত্যাদি।

নগরের কুমারপাড়া এলাকার গোলাপ মামার হোটেলের সামনেও ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় হচ্ছে। তাঁরা ক্রেতা সামলাতে হাঁপিয়ে উঠছেন। সেখানে রয়েছে জিলাপি, ঘুগনি, পেঁয়াজু, বেগুনি, মুড়ি। হোটেলের মালিক গোলাম সরদার বলছেন, ‘আমরা সাধারণ ইফতারি বেচি। আমাদের ক্রেতাও কম নয়। এ ধরনের মৌসুমি দোকান এখন নগরের অলিগলি সব জায়গায়।’