৮০ বছর ধরে শরীয়তপুরে মাঘের প্রথম সকালে বসছে জোড় ইলিশের মেলা
পয়লা মাঘ শীতের সকালে জোড়া ইলিশ মাছ ঘরে নিয়ে রান্না করে আত্মীয়স্বজনকে খাওয়ানোর প্রথা আছে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে। বাজার থেকে জোড়া ইলিশ আনার পর গৃহিণীরা ধর্মীয় বিধি মেনে তা ধান-দূর্বা ও সিঁদুর মেখে ঘরে তুলে নেন। এরপর বিভিন্ন সবজি দিয়ে রান্না করেন। পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধায় স্বজনদের পাতে তুলে দেন।
শরীয়তপুরের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বহু বছর ধরে প্রথাটি চর্চায় রেখেছেন। এ উপলক্ষে মাঘের সকালে ইলিশ শরীয়তপুর সদর উপজেলার মনোহর বাজারে বসে ‘জোড় ইলিশ মাছ’–এর মেলা। আজ ভোর থেকে শুরু এ মেলায় কয়েক শ ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিতে মুখর হয়ে উঠেছে ওই এলাকা।
মাছ ব্যবসায়ী ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষ দুর্গাপূজার পর ইলিশ মাছ খাওয়া বন্ধ করে দেন। পরবর্তী সময় পৌষসংক্রান্তির উৎসব উদ্যাপন শেষে পয়লা মাঘ দুটি ইলিশ মাছ বাজার থেকে কিনে এনে তা ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী ঘরে তুলে নেন। এরপর বেগুন, লাউ, লাউ শাক দিয়ে ওই মাছ রান্না করে আবার ইলিশ মাছ খাওয়া শুরু করেন। শরীয়তপুরের বিভিন্ন এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা জোড়া ইলিশ ঘরে নেওয়ার এ রেওয়াজকে উৎসব হিসেবে উদ্যাপন করেন।
শরীয়তপুর সদর উপজেলার মনোহর বাজার, মধ্যপাড়া, রুদ্রকর, কাশাভোগ, আংগারিয়া, ধানুকা হিন্দু–অধ্যুষিত এলাকা। এসব এলাকার মানুষের চাহিদা ও উৎসব আয়োজনের কথা বিবেচনা করে অন্তত ৮০ বছর আগে পয়লা মাঘ মনোহর বাজারে ইলিশ মাছের মেলার আয়োজন করেন এলাকার মানুষ। যেহেতু দুটি ইলিশ মাছ ক্রয় করে উৎসবটি উদ্যাপন করা হয়, তাই এটি ‘জোড় ইলিশের মেলা’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
আজ ভোরে মনোহর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা ইলিশ মাছের পসরা সাজিয়ে মনোহর বাজার স্মৃতিস্তম্ভের মাঠে বসেছেন। তার পাশে গরুর হাট মাঠে অন্য ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন খাবার ও খেলনার দোকান নিয়ে বসেছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ মেলা চলবে। ইলিশ মাছের পাশাপাশি মেলায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিয়ে হাজির হয়েছেন বিক্রেতারা।
কাশাভোগ এলাকার বাসিন্দা অনিক বসু চাকরির সুবাদে জেলা শহরে বসবাস করেন। আজ সকালে তিনি জোড় ইলিশ মাছ কিনতে মেলায় এসেছেন। দুটি ইলিশ ও মিষ্টি কিনেছেন তিনি। অনিক বসু প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশু বয়স থেকে বাবার সঙ্গে শীতের সকালে এ মেলায় আসার অভ্যাস। আজ এসেছি মাছ ও মিষ্টি কিনতে। বাবা অসুস্থ, তাই তাঁকে আনিনি। নিজেই ছুটে এসেছি। শত কর্মব্যস্ততা থাকলেও প্রতিবছর দিনটিতে মাছ কিনতে এ মেলায় ছুটে আসি।’
মেলায় বিক্রির জন্য বিভিন্ন আকারের ইলিশ রাখা হয়েছে জানিয়ে মাছ বিক্রেতা দ্বীপ দাস বলেন, যার যেমন ক্রয়ক্ষমতা, তিনি সে রকম দামের ইলিশ ক্রয় করছেন। ২০০ গ্রাম থেকে শুরু করে ১ কেজি ওজনের ইলিশ আনা হয়েছে। ২০০ গ্রাম ওজনের মাছ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি, আবার ১ কেজি ওজনের ইলিশ ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। উৎসবের কারণে দাম একটু বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান তিনি।
রুদ্রকর এলাকার বাসিন্দা প্রশান্ত দাস ডামুড্যা উপজেলা সদরে একটি সরকারি দপ্তরে কাজ করেন। আজ শিশুসন্তানকে নিয়ে মেলায় এসেছেন জোড়া ইলিশ কিনতে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাঘের প্রথম দিন ইলিশ ঘরে নেওয়ার দীর্ঘদিনের প্রথাটি পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের নিয়ে উদ্যাপন করি। মূলত আমরা ইলিশের প্রজননে ভূমিকা রাখতে দুর্গাপূজার পর, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে ইলিশ খাওয়া বন্ধ রাখি। সময়টা ইলিশের প্রজনন ও বেড়ে ওঠার সময়। ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে এ ব্যবস্থা করা হয়। তিন মাস পর যখন আবার ইলিশ খাওয়া শুরু করি, তখন একে উৎসবে রূপ দেওয়া হয়। এভাবে প্রথাটি দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে।’