প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে কাঠ পাচার

বান্দরবানের লামা সরইয়ে বনাঞ্চল ধ্বংস করে হাতি দিয়ে টানা গাছ পাচারের জন্য পালংঝিরিতে রাখা হয়েছে। গত সোমবার দুপুরে তোলাপ্রথম আলো

বান্দরবানের লামার সরইয়ে ম্রো পাড়ার প্রাকৃতিক বনাঞ্চল উজাড় করে অবাধে গাছ পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। দু্র্গম বনের গাছ সড়ক পর্যন্ত হাতি দিয়ে টেনে বন বিভাগের চেকপোস্ট পার হয়ে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয়। মৌজার হেডম্যানসহ (মৌজাপ্রধান) ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, অবাধে গাছ পাচারে লোহাগাড়া আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তাঁর ভাই জড়িত রয়েছেন।

গত রোববার সরই ইউনিয়নের লেমুপালং মৌজার লাঙ্কিপাড়া, বাকখুপাড়া এলাকায় গিয়ে বিস্তীর্ণ প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংসের চিত্র দেখ গেছে। এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধিরা বলেছেন, পাচারকারীদের অবাধ পাচারে লেমুপালং ও লুলাইংমুখের দুই–তৃতীয়াংশ প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ইতিমধ্যে ধ্বংস হয়েছে। পাচার বন্ধ না হলে কয়েক বছরের মধ্যে লেমুপালং ও লুলাইং মৌজায় আর কোনো প্রাকৃতিক বনাঞ্চল থাকবে না।

লাঙ্কিপাড়া এলাকার ৩১ ম্রো পরিবারের পানির উৎস লেমুপালং খাল। পাড়া থেকে খাল ও খাড়া পাহাড়ি রাস্তা ধরে দেড় কিলোমিটার গেলে দেখা যায় শুধু হাতি দিয়ে টানা গাছ আর গাছ। পালংঝিরি, নিচের শীলঝিরি এবং ওপরের শীলঝিরিতে ১২ থেকে ৫০ ফুট দীর্ঘ গর্জন, গামারি, কড়ই, গুটগুটিয়া, বান্দরহোলা, তেজপাতাগাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ফেলে রাখা হয়েছে। ঝিরির দুই তীরের শত বছরের প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের শত শত প্রজাতির ছোট–বড় গাছ, বাঁশ ও লতাগুল্মের ঝোপঝাড় কেটে ফেলা হয়েছে।

বিরান হওয়া পাহাড়ের পাদদেশে পালংঝিরিতে নামলে দেখা যায়, ঝিরির পানি অনেকটা দূষিত হয়েছে। উৎপত্তিস্থল চিম্বুক পাহাড় শ্রেণি পর্যন্ত পালংঝিরির দুই পারের বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ায় পানি গরম হয়ে উঠেছে। ঝিরির বাঁকে বাঁকে কেটে ফেলা ঝোপঝাড় পচে পানি লালচে রং ধারণ করেছে। পালংঝিরির পানিও দূষিত হয়ে পড়েছে।

পালংঝিরি বেয়ে কিছু দূর যেতেই পলিথিন ও খড়কুটোর ছাউনির একটি বাসা পাওয়া যায়। কিন্তু বাসায় কাপড়চোপড়, রান্নার হাঁড়িপাতিল সবকিছু আছে; কিন্তু মানুষ নেই। পায়ের খালে মো. হাসিম, জমি উদ্দিন ও আনিস নামের তিন রোহিঙ্গা শ্রমিক জানালেন, তাঁরা ১৫-১৬ দিন ধরে লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খোরশেদ আলম ও তাঁর ভাই মোরশেদ আলমের হয়ে কাজ করছেন। এখানে বনে গাছ কাটছেন। প্রতিদিন ৬০০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন তাঁরা। বনের গোলগাছ কাটার জন্য আরেকটি দল রয়েছে। ওই দলে গাছ টানার একটি হাতিও আছে। দলটি সকালে বাসা ফেলে হাতিসহ কোথায় গেছে তারা জানেন না।

লেমুপালং মৌজার হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) কাংওয়াই ম্রো বলেন, বনাঞ্চল উজাড়ে বাধা দিলে খোরশেদ আলম ও মোরশেদ আলম মামলা করার হুমকি দেন। ২০১৫ সালে বাধা দেওয়ায় পাড়াবাসীর নামে তিনটি মামলা দিয়েছিলেন। তখন থেকে মৌজাবাসী আতঙ্কে থাকেন।

বনাঞ্চল ধ্বংসে মৌজার হেডম্যানকে দুষছেন সরই ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মেনওয়াই ম্রো। তিনি বলেন, হেডম্যানের নির্লিপ্ততার কারণে লেমুপালং ও লুলাইংমুখ এলাকার বিস্তীর্ণ সবুজ প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের দুই–তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়েছে। দুর্গম এলাকার এই বন টিকিয়ে রাখতে না পারলে জনবসতি টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।

লামা উপজেলা সদর থেকে ক্যজুপাড়া হয়ে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে লেমুপালং মৌজা। সেখানে লাঙ্কিপাড়া থেকে উঁচু পাহাড় কেটে পাচারকারীদের করা ট্রাক চলাচলের রাস্তা দেখা গেছে। বনাঞ্চল কেটে গাছ ওই রাস্তা পর্যন্ত হাতি দিয়ে টেনে আনা হয়। এরপর ট্রাকে বোঝাই করে ক্যজুপাড়া পুলিশ ও বন বিভাগের চেকপোস্টের ওপর দিয়ে পাচার করা হয়।

লোহাগাড়া আওয়ামী লীগের সভাপতি খোরশেদ আলম সরই লেমুপালং এলাকায় প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের নিধন ও পাচারের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, তাঁর ওই এলাকায় আগে ব্যবসা ছিল, এখন নেই। তাঁর ছোট ভাই মোরশেদের ব্যবসা থাকতে পারে। তবে সেটা অবৈধ কোনো ব্যবসা নয়। মোরশেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি অসুস্থ্ জানিয়ে খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন।

লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. আরিফুল হক বলেছেন, লেমুপালং ও লুলাইং এলাকাগুলো দুর্গম হওয়ায় সার্বক্ষণিক নজদারি রাখা সম্ভব নয়। ক্যজুপাড়ার বন বিভাগের চেকপোস্ট হয়ে অবৈধ কাঠ পাচারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।