দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল

১৩ জনের মৃত্যু। চিকিৎসাধীন ১৫ জনের মধ্যে ৯ জনের অবস্থাই সংকটাপন্ন। তেলিরচালার বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা।

অগ্নিদগ্ধদের একের পর এক মৃত্যুতে আতঙ্কিত তেলিরচালার বাসিন্দারা। গতকাল সকালে গাজীপুরের কালিয়াকৈরেছবি: প্রথম আলো

ইফতারের আগে বাড়ির পাশের রাস্তায় খেলছিল দুই ভাই–বোন তাওহীদ ও তায়েবা। হঠাৎ সিলিন্ডারের ছিদ্র থেকে বের হওয়া গ্যাসের আগুনে দুজনই দগ্ধ হয়। তিন দিনের মাথায় গত শনিবার মারা যায় তায়েবা (৫)। পরদিনই মৃত্যু হলো তাওহীদেরও (৭)।

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচালায় ১৩ মার্চ এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তাওহীদ-তায়েবার মতো বিভিন্ন বয়সের ৩৬ জন দগ্ধ হন। এর এক দিন পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই একজন, দুজনের মৃত্যুর খবর আসছে। সবশেষ গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইয়াসিন আরাফাত (২১) ও রাতে মশিউর আলীর (২২) মৃত্যু হয়। এতে  মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩। আরও ১৫ জন ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তাঁদের মধ্যে ৯ জনের অবস্থাই সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তেলিরচালা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি টিনের ঘর। প্রতিটি ঘরেই একটি করে পরিবারের বসবাস। ১০ ফুট বাই ১০ ফুট ঘরেই গ্যাসের সিলিন্ডার দিয়ে চলে রান্নার কাজ। সেখানেই চলে খাওয়া-ধাওয়া আর থাকা। সেখানে টিনের ৬০০টি ঘর রয়েছে। এসব ঘরে প্রায় দুই হাজার মানুষের বসবাস। এমন একটি ঘরেই সেদিন সিলিন্ডার গ্যাস থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

ওই এলাকার একটি গলিতে পাঁচ-ছয়জন নারীকে বসে আগুনের দগ্ধদের নিয়ে কথা বলতে দেখা গেল। গৃহবধূ ইসমত আরা বলেন, ‘আমাদের সামনের ঘরে তিন মাস আগে ভাড়ায় উঠেন সজল মিয়া। আগুনে তাঁর ছেলে তাওহীদ ও মেয়ে তায়েবার মৃত্যু হয়েছে। পরিবারসহ তাঁরা এখন গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ আছেন।’

পেশায় বাসচালক সজল মিয়া দুই সন্তানকে হারানোর পর কিছুতেই শান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছেন না। মুঠোফোনে যোগাযোগ করতেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে সজল মিয়া বলেন, ‘তিন মাসে আগে আমি ওই বাড়িতে উঠেছি। কেন যে উঠলাম। ওই বাড়িতে না গেলে আজকে আমার দুই ছেলে-মেয়েকে হারাতে হতো না। আমার বুকটা খালি হয়ে গেছে। একটা সন্তানও যদি বাঁইচা থাকত, তাহলে তারে নিয়ে জীবনটা কাটাইতে পারতাম। আজ আমার কিছুই নাই, আমি শেষ হয়ে গেছি।’

পোশাক কারখানার শ্রমিক আমেনা বেগম ১২ বছরের মেয়ে শারমিন আক্তারকে নিয়ে তেলিরচালা এলাকার একটি কলোনিতে ভাড়া থাকেন। ঘটনার সময় তিনি কারখানায় ছিলেন। হঠাৎ খবর পান, তাঁর মেয়ে আগুনে পুড়ে গেছে। ছুটে এসে মেয়েকে উদ্ধার করে নিয়ে যান হাসপাতালে। পা পুড়ে যাওয়ায় তাঁর মেয়ে শঙ্কামুক্ত। আমেনা বেগম বলেন, ‘প্রতিদিন একজন একজন করে মরার খবর পাইতাছি। মনটা খুবই খারাপ। কাছের কয়েকজন মানুষও মারা গেছে।’

আমেনার মতো পাশের বাড়ির ইসমত আরা, ফেরদৌসি বেগম, আবুল কালামের চোখে-মুখে দেখা গেল আতঙ্কের ছাপ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবুল কালাম বলেন, ‘যারা মারা গেছে, তাদের মধ্যে দুইজন আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল।’

কোনাবাড়ীর এম এম গার্মেন্টেসের শ্রমিক আমির হোসেন বলেন, ‘পাশের বাসায় গ্যাসের শব্দ শুনে আমার মেয়েটা দেখতে গিয়েছিল কী হয়েছে। তখন হঠাৎ আগুন ধরে যায় আর আমার মেয়েটার পা পুড়ে যায়। পোড়া পা নিয়ে মেয়েটা অনেক কষ্ট করছে।’

এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছ, তেলিরচালা এলাকায় শফিকুল ইসলাম নামের একজন ব্যবসায়ী জমি ভাড়া নিয়ে কলোনি তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। সেখানকার একটি ঘরের সিলিন্ডারের গ্যাস শেষ হয়ে গেলে পাশের দোকান থেকে একটি সিলিন্ডার কিনে আনেন তিনি। সেটির চাবি খুলে গ্যাস বের হয়ে পাশের চুলার আগুনের সংস্পর্শে এলে ওই দুর্ঘটনা ঘটে।

এ পর্যন্ত মারা যাওয়া ১৩ জন হলেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের আলামপুর গ্রামের সোলায়মান মোল্লা (৪৫), বিনোটিয়া গ্রামের নার্গিস আক্তার, একই উপজেলার বেড়াকোলা গ্রামের মাইদুল ইসলাম (২৫) ও জহিরুল কুটি (৩২), একই উপজেলার তারুটিয়া গ্রামের রাব্বি (১৩), রাজশাহীর বাঘার আরিফ হোসেন (৪০), বগুড়ার শিবগঞ্জের মানদহ গ্রামের মনসুর আলী (৩৫), ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার বড়ইহাটি গ্রামের তায়েবা (৫) ও তাওহীদ (৭), একই উপজেলার সোলাইমান (৯), টাঙ্গাইলের মধুপুরের ইদুলপুর গ্রামের মোতালেব হোসেন (৪০), কুষ্টিয়ার খোকসার ইয়াসিন আরাফাত (২১) ও লালমনিরহাটের হাতিবান্ধার মশিউর আলী (২২)।

কালিয়াকৈরের ইউএনও কাউছার আহাম্মেদ বলেন, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে।