শহরের বুক থেকে হারিয়ে গেছে তিনটি নদী

দখল-বেদখলে রাজশাহী নগরের মানচিত্র থেকে তিনটি নদীর চিহ্ন মুছে গেছে। সেগুলো হচ্ছে বারাহী, স্বরমঙ্গলা ও দয়া।

সরমঙ্গলা নদীর অংশবিশেষ। রাজশাহীর পবা উপজেলার বালানগর এলাকায় গতকালপ্রথম আলো

‘আমরা এ নদীতে গোসল করেছি। আমার দাদাদের মুখে শুনেছি নদীতে লঞ্চ পর্যন্ত চলেছে। এখন কোথাও কোথাও নদী আর নেই। যেটুকু আছে, তা–ও কচুরিপানায় ঢাকা। নদীটির কী নাম ছিল, তা জানি না। এখন আমরা এটাকে রাইচাঁদ নালা বলি।’ রাজশাহী নগরের চন্দ্রিমা থানা বালানগর গ্রামের বাসিন্দা খলিলুর রহমান (৫৫) বলছিলেন তাঁর ছোটবেলার কথা। এই রাইচাঁদ নালা আসলে রাজশাহী শহরের ভেতরে পদ্মা নদী থেকে উৎপত্তি হওয়া স্বরমঙ্গলা নদীর অংশবিশেষ।

রাজশাহী শহরের ভেতরে পদ্মা নদী থেকে এ রকম তিনটি নদীর উৎপত্তি হয়েছিল। কোনোটিই আর বর্তমান মানচিত্রে নেই। একটির নাম এক ব্রিটিশ কর্মকর্তার রচিত গ্রন্থে পাওয়া যায়। আর দুটির কথা এক নদী গবেষকের গ্রন্থে মেলে। দখল-বেদখলে রাজশাহী থেকে নদীর চিহ্ন মুছে গেছে। তারপরও নগরের কিছু কিছু জলাশয় দেখলে বোঝা যায়, সেগুলো আগে নদী ছিল। এই নদী তিনটি হচ্ছে বারাহী, স্বরমঙ্গলা ও দয়া।

হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকীর ফিরিয়ে দাও সেই প্রবাহ বইতে নদীগুলোর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। বইয়ে বলা হয়, ১৮৮৫ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে পদ্মা নদীর তীর দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তখন নগরের বুলনপুর এলাকা থেকে তালাইমারী পর্যন্ত ১২টি স্লুইসগেট বা জলকপাট করা হয়। নদীগুলোর উৎসমুখেও জলকপাট বসানো হয়। এর পর থেকে আস্তে আস্তে নদীগুলোর উৎসমুখ মরে যেতে থাকে। একপর্যায়ে নদীর পরিচয় হারিয়ে যায়। মানুষ ভুলে যায় নদীর নাম। বর্তমানে নদীর বাঁ তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় পদ্মার তীরে ব্লক বসিয়ে পাকা করে দেওয়া হয়েছে। এর ভেতরেই ঢাকা পড়ে যায় একসময়ে প্রমত্ত নদীগুলোর উৎসমুখ।

বারাহী নদী সম্পর্কে প্রথম তথ্যটি পাওয়া যায় ১৮৮৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও ব্রিটিশ ভারতের ডিরেক্টর জেনারেল অব স্ট্যাটিসটিকস উইলিয়াম উইলসন হান্টারের লেখা বই থেকে। বইটির নাম স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব রাজশাহী। সেখানে বলা হয়, বারাহী নদীর উৎসমুখ রাজশাহী নগরের ফুদকিপাড়া মহল্লায় পদ্মা থেকে। নদীটি পবা থানার মহানন্দখালি গ্রামে বারনই নদীতে গিয়ে পড়ে। বর্তমানে উৎস থেকে প্রথম পাঁচ কিলোমিটারে নদীর কোনো অস্তিত্ব নেই। ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর বাকি অংশটুকুও মৃত। এর মোহনায় অপর একটি জলকপাট নির্মাণ করে নদীর মৃত্যু ডেকে আনা হয়েছে বলে নদী গবেষকেরা মনে করেন।

রাজশাহী নগরের তালাইমারী এলাকায় ছিল স্বরমঙ্গলা নদীর উৎসমুখ। খরস্রোতা এই নদী নগরের কাজলা-জামালপুর ও নামোভদ্রা এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হতো বলে জানা যায়। এই জামালপুর মৌজায় পড়েছে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট)। রুয়েট ক্যাম্পাসের উত্তর-পূর্ব অংশ এখনো নাওডোবা নামে পরিচিত। কথিত আছে, স্বরমঙ্গলা নদীপথে ধনপতি সওদাগর নামের একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী তাঁর ছেলের বরযাত্রী নিয়ে যাচ্ছিলেন। বর্তমান রুয়েট ক্যাম্পাসের এই এলাকায় নৌকাডুবিতে ধনপতির সলিলসমাধি হয়েছিল। এখনো এই নিচু জলাভূমিটি খালি চোখে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এটি একটি মরা নদীর ধারা।

অন্যদিকে স্বরমঙ্গলার শাখানদী দয়া। উত্তর-পশ্চিমমুখী হয়ে বর্তমান রুয়েট এলাকায় প্রবেশের ২০–২৫ গজ আগে দয়া নদীর জন্ম। সেখান থেকেই দয়া উত্তরমুখী হয়েছে। নদীটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম দেয়াল বরাবর উত্তর দিকে বয়ে গেছে। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম দেয়ালের পাশে তাকালে নদীর রেখা বোঝা যায়।

স্থানীয় লোকজন বলেন, রেললাইনের উত্তর পাশে কিছুদিন আগেও দয়া নদীর খাতটি এখনো বেশ স্পষ্ট ছিল। সমতল থেকে প্রায় ৪ ফুট গভীর ও প্রায় ২৫ গজ প্রশস্ত এই জলাভূমিতে বছরের ৬ মাস পানি থাকত। জলজ উদ্ভিদও ছিল এখানে। নদীটি রাজশাহীর মেহেরচন্ডি, খড়খড়ি বাজার, কুখুন্ডী, বামন শিকড়, মল্লিকপুর, তেবাড়িয়া, সারাংপুর হয়ে ঘোলহারিয়া গ্রামে পুনরায় স্বরমঙ্গলার সঙ্গে মিলিত হয়ে সম্মিলিত প্রবাহ ফলিয়ার বিলে পতিত হতো।

এ বিষয়ে নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, রাজশাহীর হারিয়ে যাওয়া স্বরমঙ্গলা নদীর অনেক জায়গা এখনো দখলমুক্ত রয়েছে। নদীর এই অংশ খনন করে সেচের কাজে ব্যবহারের জন্য সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারে।

রাজশাহী জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সিএস রেকর্ডে যেখানে নদী ছিল, সেই জায়গাগুলো প্রশাসন ইতিমধ্যে চিহ্নিত করেছে। পিলার বসানো এবং দখলমুক্ত করার জন্য চিঠি দিয়ে বরাদ্দের আবেদন করা হয়েছে।