কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা ও গঙ্গাধর, দুধকুমার নদের ভাঙনে গত এক যুগে প্রায় ৩০ হাজার পরিবার নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে গেছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। এসব নদ-নদী ভাঙনের শিকার পরিবারগুলো অন্যের জমিতে, বাঁধের রাস্তায় আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। ভাঙনের শিকার অনেক পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে দিনাজপুর পার্বতীপুর, ঢাকা, ঠাকুরগাঁও জেলায় পারি জমিয়েছেন।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুল হাই সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ২০১২ থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত কুড়িগ্রামের ৯টি উপজেলায় নদ-নদীর ভাঙনে প্রায় ২৭ হাজার ৮৮০টি পরিবার বসতবাড়ি হারিয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১ হাজার ৮২১টি, ভূরুঙ্গামারীতে ৬০৯টি, নাগেশ্বরীতে ২ হাজার ৪২৬টি, ফুলবাড়ীতে ১৮৮টি, রাজারহাটে ৪৩৯টি, উলিপুরে ৫ হাজার ৯০৪টি, চিলমারীতে ৪ হাজার ৫১৯টি, রৌমারীতে ২ হাজার ১৮৩টি এবং চর রাজীবপুরে ৩ হাজার ৮৫টি পরিবার জমি ও বসতবাড়ি হারিয়েছে। আবদুল হাই সরকার বলেন, ‘আগস্টের পর আমাদের কাছে হিসাব নেই। এখন ভাঙন আরও বেড়েছে। ফলে বসতবাড়ি হারানো পরিবারের মোট সংখ্যাটি প্রায় ৩০ হাজার হবে।’
জেলার বর্তমানে ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন রয়েছে। এর মধ্যে রৌমারী ও চর রাজীবপুর উপজেলায় ভাঙন বেশি।
কুড়িগ্রাম জেলার অভিবাসীদের জীবনমান ও সংখ্যা নিয়ে ২০১৯ সাল থেকে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। এটি জাতিসংঘের অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা। আইওএমের জেলা কমিউনিটি সমন্বয়ক রুকুনুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কুড়িগ্রামের প্রায় চার শতাধিক চরে প্রতিবছর ভাঙনের ফলে অন্তত পাঁচ হাজার পরিবার অভ্যন্তরীণ স্থানান্তরের শিকার হয়। এ ছাড়া ভাঙনের শিকার হয়ে গত তিন বছরে জেলার প্রায় সাত শতাধিক পরিবার ভূমিহীন হয়ে স্থায়ীভাবে ঢাকাসহ অন্য জেলায় চলে গেছে।
সরেজমিনে গতকাল বৃহস্পতিবার চর রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি ও মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের বিভিন্ন চরাঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, শত শত বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ফসলি জমিতে ভাঙন দেখা গিয়েছে। কোদালকাটি ইউনিয়নের পাইকান টারী ও সাজাই গ্রামে ব্যাপক নদীভাঙন শুরু হয়েছে। এর মধ্যে কোদালকাটি বাজার, ইউনিয়নের সবচেয়ে পুরাতন বিদ্যাপীঠ বদরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোদালকাটি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, সাদাকাত হোসেন উচ্চবিদ্যালয়, মধ্য চর সাজাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইউনিয়ন পরিষদ, ইউনিয়ন ভূমি অফিসসহ প্রায় ২০টি সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত তিন মাসে এই ইউনিয়নের প্রায় দুই শতাধিক পরিবার বসতভিটা হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। ভাঙনকবলিত এলাকার অনেকেই যাওয়ার জায়গার অভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিবার-পরিজনসহ নদীর তীরেই বসবাস করছেন। এ ছাড়া গত ১২ বছরে ওই ইউনিয়নের ৩, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড পুরোপুরি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ওই তিন ওয়ার্ডের প্রায় ৭ হাজার মানুষ সবকিছু হারিয়ে এখন ভূমিহীনের তালিকায় রয়েছে। উপজেলার মোহনগঞ্জ ইউনিয়নেও একই চিত্র। ইউনিয়নের নয়ারচর, চর নেওয়াজি, শংকর মাধবপুর, হাজিপাড়া, ফকিরপাড়া ও ব্যাপারীপাড়া ভাঙনে এখন বিলীন।
কোদালকাটি ইউনিয়নের পাইকান টারী গ্রামের বাসিন্দা শহিদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত সোমবার রাতে নদীতে পাক দিয়া ভাঙন শুরু হয়। ঘুমের ছাওয়াক পাশের বাড়িত থুইয়া, এলাকাবাসীর সাহায্য-সহযোগিতায় দুইটা ঘর নিয়া যায়া মানষের ভিটাত খাড়া করি রাখছি। আর একটা ঘর আছিল, তা–ও আজ নদীর প্যাটোত গেইল। এল্যা কোনো জায়গাত বাড়ি করমো, তার ব্যবস্থা নাই।’
কুড়িগ্রাম পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, জেলার বর্তমানে ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন রয়েছে। চর রাজীবপুর উপজেলার মোহনগঞ্জ ও কোদালকাটি ইউনিয়নে দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন তীব্রতা রয়েছে। এর মধ্যে আধা কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন রোধে কাজ চলমান রয়েছে।