‘ঘরোত ধান থাকলে দাম পাইনে, দাম বাড়লে ধান থাকে না’

গাইবান্ধা সদর উপজেলার হাসেম বাজার এলাকায় গড়ে ওঠা ধান ক্রয়ের পাইকারি দোকানছবি: প্রথম আলো

‘হামারঘরে কিরসোক মানুষ। দাদা আমল থাকি চাষাবাদ করব্যার নাগচি। সোংসারোত কারও চাকরি নাই, ব্যবসাও নাই। ধান–চাউল বেচি সার, তেল কিনি, কামলার দাম দিই, দায়দেনা মিটাই। একন ধান কাটা মৌসুম। ধান বেচি কামলার দাম দোমো। কিনতো বাজারোত ধানের দাম নাই। হামারঘরে কপাল খারাপ, ঘরোত ধান থাকলে দাম পাইনে, দাম বাড়লে ধান থাকে না। হামরা সোরকারি গুদামোত ধান বেচপ্যার পাইনে। বাদ্য হয়া পোত্তেক মোন মোটা ধান ৭৯০ ট্যাকা করি পাঁচ মোন ব্যাপারীর কাচে বেচনো।’

রোববার বিকেলে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন কৃষক আশরাফ আলী (৫৫)। তিনি গাইবান্ধা সদর উপজেলার হাসেম বাজার এলাকায় ধান বিক্রি করতে এসেছিলেন। তাঁর বাড়ি হাসেম বাজার গ্রামে।

একই গ্রামের কৃষক মিজান মিয়া (৪৫) বললেন, ‘সোরকারি গুদামোত ধান নিয়া গেলে ওমরা (খাদ্য কর্মকর্তা) কয় তোমারঘরে ধান ভিজে, ভালো নোয়ায়। তাই ব্যাপারী ছাড়া হামারঘরে ধান বেচার বুদ্ধি নাই।’ আশরাফ ও মিজানের মতো অন্তত ২৫ জন কৃষক ধান বেচাকেনা নিয়ে তাঁদের কষ্টের কথা জানালেন।

চলতি বোরো কর্তন মৌসুমে গাইবান্ধার হাটবাজারে ধান ওঠা শুরু হয়েছে। কিন্তু পানির দামে ধান বেচাকেনা চলছে। বর্তমানে স্থানীয় বাজারে প্রতি মণ মোটা ধান ৭৫০ টাকা ও চিকন ধান ৮৫০ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। ৭ মে থেকে সরকারিভাবে ধান কেনা শুরু হয়েছে। এবার প্রতি মণ ধানের সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ২৮০ টাকা এবং প্রতি কেজি চাল ৪৫ টাকা।

গাইবান্ধার কয়েকটি জায়গায় গিয়ে দেখা গেল কম দামে ধান বিক্রির দৃশ্য। কৃষকেরা ব্যাপারীর গুদামে ধান নিয়ে গেলে তাঁরা ধান কিনতে চাইছেন না। সদর উপজেলার হাসেম বাজারে গিয়ে দেখা গেল, কয়েকজন কৃষক রিকশাভ্যানে ধান বিক্রি করতে নিয়ে এসেছেন। তাঁদের একজন বারুইপাড়া গ্রামের কৃষক হারুন-অর-রশিদ (৫৫)। তিনি বললেন, ‘আজ সারা দিন চারজন কৃষিশ্রমিক আমার জমির ধান কেটেছে। প্রতিজনের মজুরি ৭০০ টাকা। চারজনকে ২ হাজার ৮০০ টাকা দিতে হবে। তাই পাঁচ মণ ধান বিক্রি করতে ব্যাপারীর কাছে এসেছি। সব ব্যাপারী ধানের দাম কম বলছে। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে প্রতি মণ বিআর-২৮ জাতের ধান ৭৫০ টাকা করে বিক্রি করলাম।’

চাপাদহ গ্রামের কৃষক হায়দার আলী (৬০) বলেন, দুই বিঘাতে বিআর-২৮ জাতের ধানের চাষ করতে সার, বীজ, সেচ, রোপণ ও কাটায় খরচ পড়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। দুই বিঘায় ধান উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ৩৪ মণ। বর্তমান বাজারে গড়ে প্রতি মণ ধান ৭৫০ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। এ হিসাবে ৩৪ মণের দাম দাঁড়ায় ২৫ হাজার ৫০০ টাকা। এ বছর দুই বিঘায় তাঁর সাড়ে ৪ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হবে। বর্তমানে বাজারে ধানের দাম কম, ফলে লোকসান হবে বেশি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসেম বাজারের এক ধান ব্যবসায়ী বলেন, এখন যেসব ধান আসছে, সেগুলো ভেজা। তাই কোনো ব্যবসায়ী এখনই  ধান কেনার ঝুঁকি নিচ্ছেন না। কিছু কিছু ব্যবসায়ী কম দামে ধান কিনে রাখছেন, পরে তাঁরা বেশি দামে বিক্রি করবেন।    
এসব বিষয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মিজানুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, এখন ভরা মৌসুম। এবার বোরো ধানের উৎপাদন ভালো হয়েছে এবং বাজারে সরবরাহ বেশি। এ ছাড়া সাধারণত মৌসুম সময়ে ধান ভেজা থাকে। তাই দামও কম থাকে। ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু হলেও রোববার পর্যন্ত ধান কেনা হয়নি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এ বছর জেলার সাতটি উপজেলায় ১ লাখ ২৮ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। চাষ হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ২০৫ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চাল আকারে ৫ লাখ ৬২ হাজার ৮১৯ মেট্রিক টন।