হাঁসের মাংসের ‘মোড়কে’ পাখির মাংস বিক্রি, কেন–কীভাবে
পরপর কয়েকটি অভিযানের মুখে সিলেটের জৈন্তাপুরের হরিপুর বাজারে প্রকাশ্যে পাখির মাংস বিক্রি বন্ধ বলা হলেও গোপনে বেচাকেনা চলছে বলে অভিযোগ। সেখানকার রেস্তোরাঁগুলোতে হাঁসের মাংসের আড়ালে চলে পাখির মাংস বিক্রি। সম্প্রতি সেখানকার কয়েকটি রেস্তোরাঁয় ক্রেতা সেজে ঢুঁ মেরে প্রথম আলোর প্রতিবেদক এমনটাই দেখেছেন।
জলাভূমি থেকে রেস্তোরাঁয় পাখি
সম্প্রতি পরিচয় গোপন রেখে রেস্তোরাঁর মালিক ও কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফাঁদ পেতে অথবা বিষটোপ দিয়ে শিকারিরা পাখি ধরেন। সিলেটের গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার বিভিন্ন হাওর ও জলাভূমি থেকে পাখিগুলো ধরা হয়। এরপর পাখি বাড়িতে নেন শিকারিরা। জবাই করে পালক ছাড়িয়ে পলিথিনে মুড়ে নেন। এরপর গোপনীয়তার সঙ্গে সেগুলো পৌঁছে দেন রেস্তোরাঁমালিকদের কাছে।
স্থানীয় কয়েকজনের ভাষ্য, শীতকালে এখানে প্রতিদিন গড়ে কয়েক শ পাখি রান্না হয়। তবে সম্প্রতি প্রশাসন দফায় দফায় এখানে অভিযান চালিয়েছে। এ কারণে পাখির মাংস বিক্রি অনেকটা কমে গেছে, তবে একেবারে বন্ধ হয়নি। হাঁসের মাংসের কথা বলে পাখির মাংস বিক্রির কাজটি চলছে।
পাখির মাংস খেতে এসেছেন, এমন দুজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রেস্তোরাঁ কর্মীরা তাঁদের জানিয়েছেন যে প্রতিদিন সর্বোচ্চ তিন থেকে সাত প্রজাতির পাখির মাংস এখানে মেলে। এর মধ্যে বক, ঘুঘু, বালিহাঁস, ডাহুক, শামুকভাঙা ও কুড়া আছে। যেকোনো প্রজাতির পাখির এক টুকরা মাংসের সঙ্গে ভাত, ডাল ও সালাদ ফ্রি। পাখির প্রজাতি অনুযায়ী দাম ১৩০ থেকে ২০০ টাকা।
আট থেকে নয় বছর আগে সিলেট-তামাবিল আঞ্চলিক মহাসড়কের হরিপুর বাজারে কয়েকটি রেস্তোরাঁ চালু হয়। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০টিতে। চালুর পর থেকেই এসব রেস্তোরাঁয় পাখির মাংস বিক্রি শুরু হয়। মূলত সড়ক দিয়ে চলাচল করা পর্যটক ও ট্রাকচালকেরা এসব মাংসের ক্রেতা। সিলেট শহর থেকেও দলবেঁধে অনেকে পাখির মাংস খেতে যান।
সরেজমিনে দুই ঘণ্টা
এই প্রতিবেদক ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত হরিপুর বাজারে কয়েকটি রেস্তোরাঁয় যান। দেখতে পান, রেস্তোরাঁগুলোর ভেতরে ক্যাশ কাউন্টারের সামনে সারি সারি বোল প্লাস্টিকের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা। সেসব বোলে নানা আকৃতির মাংস রান্না করে রাখা। ক্রেতা এসে ঢাকনা উল্টে দরদাম করছেন। পছন্দ হলে মাংস নিয়ে রেস্তোরাঁয় বসে খাচ্ছেন।
এই দিন ক্রেতা সেজে কথা বললে সোনার বাংলা রেস্টুরেন্ট, তারু মিয়া রেস্টুরেন্ট ও তানভীর রেস্টুরেন্টের কর্মীরা পাখির মাংস বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করেন। তাঁরা বলেন, স্থানীয় প্রশাসন অভিযান চালাচ্ছে। তাই তাঁরা ভয়ে আছেন। পাখির মাংস বিক্রির বিষয়টি প্রকাশ্যে বলেন না। প্রকৃত ক্রেতা নিশ্চিত হলেই কেবল পাখির মাংস বিক্রির বিষয়টি তাঁরা বলেন। নইলে কেবল হাঁসের মাংস পাওয়া যাওয়ার কথা বলেন ক্রেতাদের।
পরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে রেস্তোরাঁগুলোতে আবার গেলে কর্মীরা পাখির মাংস বিক্রির বিষয় অস্বীকার করেন। তাঁরা বলেন, তাঁরা কোনো পাখির মাংস বিক্রি করেন না। বিক্রি করেন পাতিহাঁস ও রাজহাঁসের মাংস। হাঁসকে বড়, মাঝারি ও ছোট আকৃতির করে রান্না করে বিভিন্ন পাত্রে সাজিয়ে রাখা হয়। কেউ পাখির মাংস খাওয়ার জন্য বারবার বললে তখন এগুলোকে পাখির মাংস বলে বিক্রি করেন তাঁরা। তাঁদের রেস্তোরাঁয় হাঁসের মাংসের পাশাপাশি মোরগ ও কোয়েলের মাংস আছে।
দুই ঘণ্টা অবস্থানকালে হরিপুরের রেস্তোরাঁগুলোর সামনের সড়কের দুই পাশে পর্যটকবাহী বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ট্রাক ও মাইক্রোবাস সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো দেখা যায়। এসব যানের আরোহীরা নেমে রেস্তোরাঁয় ঢোকেন। প্রায় প্রতিটি দোকানেই ছিল নারী-পুরুষের ভিড়। সারা রাতই রেস্তোরাঁগুলো খোলা থাকে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।
অভিযানেও থেমে নেই বিক্রি
বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী, কোনো পাখি বা পরিযায়ী পাখির মাংস কেনাবেচা অপরাধ। আইনে ৬ মাসের কারাদণ্ড অথবা ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের পাশাপাশি উভয় দণ্ডের বিধান আছে।
প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ১০ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্থানীয় প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বন বিভাগ ও পুলিশের সমন্বয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। এ সময় রান্না করা পাখির মাংসের পাশাপাশি রেফ্রিজারেটর ও পলিথিনে সংরক্ষিত জবাই করা নানা প্রজাতির ২২৩টি পাখি জব্দ করা হয়।
এই দুই দিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন জৈন্তাপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা আক্তার। ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি তানভীর রেস্টুরেন্ট ও চুয়াডাঙ্গা রেস্টুরেন্টের মালিককে পাখির মাংস বিক্রি করায় ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। এ ছাড়া ৯টি রেস্টুরেন্ট থেকে বিভিন্ন প্রজাতির জবাই করা ৭৩টি পাখি জব্দ করা হয়েছে।
১৬ ফেব্রুয়ারি অভিযানে আনন্দ রেস্টুরেন্ট, শাহপরান রেস্টুরেন্ট, শাহজালাল রেস্টুরেন্ট, নিউ গ্রামবাংলা রেস্টুরেন্ট ও সোনার বাংলা রেস্টুরেন্টকে ৯ হাজার ৫০০ টাকা করে মোট ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযানে আরও কয়েকটি রেস্টুরেন্ট থেকে ১৫০টি বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি জব্দ করা হয়। পরে জব্দ পাখিগুলো পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়।
করণীয় কী
সিলেটের পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, প্রশাসনের অভিযান ও তৎপরতা সত্ত্বেও পাখির মাংস বিক্রি চলছে। এ ধরনের কাজে যুক্ত ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার পরামর্শ তাদের। এতে হয়তো পাখির মাংস বিক্রি স্থায়ীভাবে বন্ধ করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এটা ঠিক যে সম্প্রতি দুই দফা অভিযানে ব্যবসায়ীরা অনেকটা ভয় পেয়েছেন। এমন অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। সিলেটের হাওরগুলোতে অবাধে পাখি শিকার বন্ধ করতে হবে।
হরিপুরে পাখির মাংস বিক্রি বন্ধে ১৭ ফেব্রুয়ারি বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং জৈন্তাপুর উপজেলা প্রশাসন মতবিনিময় সভা করেছে। রেস্তোরাঁতে পাখির মাংস বিক্রি হয় না, এমন প্রচারণা রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা আগত ক্রেতা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করবেন, এমন উদ্যোগের পরামর্শ আসে। এ ছাড়া নানা স্থানে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে পাখির মাংস না খাওয়া, আইন ভঙ্গ করলে কী ধরনের শাস্তি হতে পারে; এগুলোর ব্যাপারে সচেতন করা হবে।
সার্বিক বিষয়ে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, অভিযান চালানো হচ্ছে। হরিপুরে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। এরপরও যদি ব্যবসায়ীরা পাখির মাংস বিক্রি করেন, তবে বিষয়টি দুঃখজনক। প্রয়োজনে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একই ধরনের কথা বললেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ। তিনি বলেন, হরিপুরে কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে পাখির মাংস জব্দের পাশাপাশি জরিমানাও করা হয়েছে। ভবিষ্যতে রেস্তোরাঁমালিকেরা যাতে পাখির মাংস বিক্রি না করেন, সতর্কও করা হয়েছে। একই অপরাধ চলতে থাকলে প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নেবে।