লোকালয়ে ফিরেছেন বাওয়ালিরা

নৌকা থেকে গোলপাতা নিয়ে ডাঙায় তুলছেন বাওয়ালিরা। গতকাল কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন মহেশ্বরীপুর এলাকার কয়রা নদীর তীরেছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবনের অভ্যন্তরে শেষ হয়েছে গোলপাতা আহরণের মৌসুম। এরই মধ্যে গোলপাতা নিয়ে বাওয়ালিদের বড় নৌকাগুলো ফিরে এসেছে লোকালয়ে। বাড়ি ফিরেই বাওয়ালিরা এখন মহাব্যস্ত গোলপাতা বিক্রির কাজে। তবে তাঁদের দাবি, গোলপাতার কদর আগের মতো না থাকায় এখনো তেমন সাড়া মেলেনি ক্রেতাদের।

গতকাল শুক্রবার সকালে খুলনার কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের পাড়ে কথা হয় বাওয়ালি আলমগীর হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, গত ৩১ মার্চ সুন্দরবনে গোলপাতা আহরণের সময়সীমা শেষ হলেও গোলপাতাবোঝাই বড় নৌকা নিয়ে লোকালয়ে ফিরতে লেগেছে আরও তিন-চার দিন। গোলপাতার ব্যবসা আগের মতো নেই। একসময় গোলপাতার ছাউনির ঘরের প্রচলন থাকায় এর চাহিদাও ছিল অনেক। তখন গোলপাতা কাটতে যাওয়ার আগে অনেকে পাতা কিনতে আগাম টাকা দিতেন। আর এখন আগাম দূরে থাক, পাতা ডাঙায় আনার পরেও কিনতে চান না। গত বছরের কেটে আনা গোলপাতা এখনো রয়ে গেছে অনেক। তারপরও এই ব্যবসা বাপ–দাদার আমল থেকেই চলে আসছে, তাই ছাড়তে পারেন না।

সুন্দরবন থেকে গোলপাতা কেটে এনে খরচই ওঠে না। বাজারে গোলপাতার কদর নেই। টিনের প্রচলন এখন বেশি।
কামরুল ইসলাম, বাওয়ালি

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের আওতাধীন এলাকা থেকে গোলপাতা কাটার মৌসুম শুরু হয় এবার ২৯ জানুয়ারি থেকে। প্রথম দফায় ২৮ দিনের অনুমতি পেয়ে ৯৭টি নৌকা নিয়ে ৪৮৫ জন বাওয়ালি সুন্দরবনে ঢোকেন। একইভাবে ১ মার্চ থেকে দ্বিতীয় দফায় ৬০টি নৌকার অনুমতি নিয়ে গোলপাতা আহরণে যান ৩০০ জন বাওয়ালি। একটি নৌকায় সর্বোচ্চ ২০০ কুইন্টাল গোলপাতা বহন করে লোকালয়ে ফিরেছেন তাঁরা। গত বছর খুলনা রেঞ্জের আওতায় দুই দফায় ২০০টি নৌকায় এক হাজার বাওয়ালি গোলপাতা আহরণে সুন্দরবনে প্রবেশ করেছিলেন। আর এ বছর ১৫৭টি নৌকার পাস নিয়ে ৭৮৫ জন বাওয়ালি সুন্দরবনে প্রবেশ করেন।

গতকাল সুন্দরবন–সংলগ্ন মহেশ্বরীপুর এলাকার কয়রা নদীর তীরে গিয়ে দেখা যায়, নদীর চরে গোলপাতায় ভর্তি বড় একটি নৌকা বাঁধা। নৌকা থেকে কয়েকজন গোলপাতার বোঝা কাঁধে করে বয়ে এনে নদীর বেড়িবাঁধের ওপর স্তূপ আকারে সাজিয়ে রাখছেন।

বাঁধের ওপর সারিবদ্ধভাবে গোলপাতা সাজানোর ফাঁকে বাওয়ালি কামরুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবন থেকে গোলপাতা কেটে এনে খরচই ওঠে না। ১ কাউন (১২৮০টি পাতা=১ কাউন) গোলপাতা ২ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। তারপরও বাজারে গোলপাতার কদর নেই। টিনের প্রচলন এখন বেশি। এসব কারণে খুব কম সংখ্যক লোক এখন বাওয়ালি পেশায় আছেন।

বাওয়ালিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে প্রতি কুইন্টাল গোলপাতা আহরণে রাজস্ব ছিল ২৫ টাকা। এখন তা বাড়িয়ে ৬০ টাকা করা হয়েছে। এরপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট। এই হিসাবে বড় একটি নৌকার পাস পেতে ১৫ হাজার টাকা রাজস্ব দিতে হয়েছে। শ্রমিকের খরচও অনেক বেড়েছে। আগে দশ থেকে বারো হাজার টাকা মাসিক মজুরিতে একজন শ্রমিক পাওয়া যেত। এবার সেখানে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা লেগেছে। সব মিলিয়ে এক নৌকা গোলপাতা আনতে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

কয়রার আমাদী এলাকার বাওয়ালি আবদুল মালেক গাইন বলেন, সুন্দরবনের মধ্যে গোলপাতা কাটতে কোনো অসুবিধে হয়নি। তবে এখন বেচাবিক্রিতে যত অসুবিধা। বন বিভাগের পারমিট নিয়ে শ্রমিক খাঁটিয়ে গোলপাতা কেটে এনে বিক্রি করে যে টাকা খরচ হয় তা–ও ওঠে না। এবার প্রতি পোন (৮০টি পাতা=এক পোন) গোলপাতার দাম চাচ্ছেন ২০০ টাকা করে। তবে এখনো কেউ একটি পাতাও নেননি। ঘরের ছাউনি হিসেবে এখন টিনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি।

সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের গোলপাতা আহরণের কূপ (জোন) কর্মকর্তা মো. তানজিলুর রহমান বলেন, গোলপাতা আহরণে বন বিভাগের শর্ত ছিল ৫০০ মণের বেশি ধারণক্ষমতার নৌকা অনুমতি পাবে না। এ ছাড়া গোলপাতা আহরণের নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত বনে অবস্থান করা যাবে না, গোলপাতার ঝাড়ের মাইজপাতা ও ঠেকপাতা কোনোভাবেই কাটা যাবে না। বন বিভাগের কঠোর নজরদারির কারণে সব নিয়ম মেনে গোলপাতা কেটে বাড়ি ফিরেছেন বাওয়ালিরা।

তানজিলুর রহমান আরও বলেন, চলতি মৌসুমে সুন্দরবনের হাটডোড়া খাল এলাকায় বন্য প্রাণীর বিচরণ বেশি দেখা যাওয়ায় ওই এলাকায় বাওয়ালিদের গোলপাতা কাটতে দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া দিন দিন গোলপাতার চাহিদা কমে যাওয়ায়, আগের তুলনায় বাওয়ালির সংখ্যাও কমেছে।