ঘুমন্ত দম্পতির ঘরে ঢুকে পড়ল এমপিপুত্রের গাড়ি, রাতারাতি মেরামত, এল নতুন আসবাব

বগুড়ার ধুনট-শেরপুর আঞ্চলিক সড়কের পাশে ভেঙে যাওয়া ঘর নতুন টিন দিয়ে সংস্কার করা হয়েছে। আহত মফিজ শেখ পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটছেন। রোববার দুপুরে ধুনটের উল্লাপাড়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

রাত আনুমানিক দেড়টা! বগুড়ার ধুনট-শেরপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক–সংলগ্ন ধুনট সদর ইউনিয়নের উল্লাপাড়া গ্রামের টিনের বেড়ার ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন মফিজ উদ্দিন শেখ ও আলেয়া বেগম দম্পতি। গভীর রাতে হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই চলন্ত গাড়ি আচমকা টিনের বেড়া ভেঙে ঢুকে পড়ে ঘরে। ঘরের আসবাব ও খাট ভাঙার শব্দে ঘুম ভাঙে মফিজ শেখের। ততক্ষণে গাড়ির ধাক্কায় ঘুমন্ত মফিজের বাঁ পা মচকে গেছে। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান ওই দম্পতি।

গত শুক্রবার রাতে বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধুনট) আসনের সংসদ সদস্য হাবিবর রহমানের ছেলে ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসিফ ইকবাল ওরফে সনির ব্যক্তিগত গাড়ি (ঢাকা-মেট্রো-ঘ-১৭-৪৬৩২) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মফিজের শয়নকক্ষে ঢুকে পড়লে টিনের বেড়ার ঘর দুমড়েমুচড়ে যায়। অল্পের জন্য বেঁচে যান ঘুমন্ত স্বামী-স্ত্রী। এ ঘটনায় আহত মফিজ-আলেয়া দম্পতি হাসপাতালে ভর্তি হলেও তড়িঘড়ি করে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। তাঁদের লন্ডভন্ড ঘরও রাতারাতি মেরামত করা হয়েছে। এসেছে নতুন আসবাব। চিকিৎসার ব্যবস্থা থেকে সবকিছুই নিজ উদ্যোগে সেরেছেন সংসদ সদস্যের ছেলে আসিফ ইকবাল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন, আসিফ ইকবাল মদ্যপ অবস্থায় নিজেই গাড়ি চালিয়ে ধুনট থেকে শেরপুর শহরের বাসায় ফিরছিলেন। মদ্যপ থাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি ঘরে ঢুকে পড়ে। দুর্ঘটনার পর চালকের আসনে আসিফ ইকবালকে বসে থাকতেও দেখা গেছে। এ সময় তাঁর সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন ধুনট উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মোহসিন আলম।

তবে চালকের আসনে থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা আসিফ ইকবাল। তিনি বলেন, ‘চালকের আসনে আমি না; গাড়িচালক নাজমুল ছিলেন। মধ্যরাতে বৃষ্টি পড়ছিল। চলন্ত গাড়ির সামনের ডান চাকা ফেটে গেলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি সড়কের পাশে টিনের বেড়ার ঘুরে ঢুকে পড়ে। এটা দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনায় বাড়ির গৃহকর্তা ও তাঁর স্ত্রী সামান্য চোট পেয়েছিলেন। আমি নিজ উদ্যোগে তাঁদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেছি। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ঘর মেরামত ও কিছু আসবাব কিনে দেওয়া হয়েছে।’ মদ্যপ থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অপপ্রচার। আমার সুনাম ক্ষুণ্ন করতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা দুর্ঘটনার বিষয়টি রং লাগিয়ে অপপ্রচার করছে। আমি মদ্যপ ছিলাম না।’

মফিজ শেখের ঘরের ভেঙে যাওয়া আসবাব। রোববার দুপুরে ধুনট উপজেলার উল্লাপাড়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

রোববার সরেজমিনে দেখা গেছে, মফিজ শেখের নতুন ঝকঝকে টিনের ঘর। টিনের বেড়ার ঘরে ছিল বাঁশের খুঁটি। এখন তা বদলে সিমেন্টের খুঁটি দেওয়া হয়েছে। ঘরের ছাউনি পুরোনো টিনের হলেও ঘরের বেড়ায় লাগানো হয়েছে ঝকঝকে টিন। ঘরে বিভিন্ন নতুন আসবাব শোভা পাচ্ছে।

মফিজ শেখের ছেলে আমিনুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার রাত দেড়টার দিকে হঠাৎ বাবার চিৎকার শুনে তিনি তড়িঘড়ি করে ওঠেন। দেখেন একটি গাড়ি মা-বাবার ঘরে ঢুকে পড়েছে। ওই গাড়ির চালকের আসনে বসা ছিলেন আসিফ ইকবাল। গাড়ির ধাক্কায় খাট ভেঙে যায়। মা–বাবা আঘাত পেয়ে কাতরাচ্ছিলেন। এরপর সংসদ সদস্যের ছেলে মিনিট পাঁচেক থাকার পর গাড়ি চালিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। সকালে মা–বাবাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। আজ রোববার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। চিকিৎসার যাবতীয় খরচ সংসদ সদস্যের ছেলে বহন করেছেন। এ ছাড়া গতকাল শনিবার সকালে লোকজন পাঠিয়ে ভেঙে যাওয়া ঘর মেরামত করে দিয়েছেন। ঘরে গাড়ি ঢুকে ভেঙে যাওয়া খাট, স্টিলের বাক্সসহ বেশ কিছু আসবাব কিনে দিয়েছেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বেলা দেড়টার দিকে বাড়ি ফেরেন মফিজ শেখ (৬৫)। তিনি বলেন, ধুনট বাজারে মসলার দোকান চালিয়ে তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। শুক্রবার বাজার থেকে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। পাশে স্ত্রী ছিলেন। গভীর রাতে হঠাৎ কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই টিনের বেড়া ভেঙে চলন্ত গাড়ি ঘরে ঢুকে পড়ে। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে খাট। একটু হলেই গাড়ি উঠে যেত শরীরে। খাট ভেঙে পা মচকে যায়। মফিজের স্ত্রী আলেয়া বেগম (৫৫) বলেন, ‘তখন ম্যালা রাত। কয়টা বাজে তা কইবার পারমু না। হঠাৎ টিন ভাঙার মরমর শব্দ। চোখ ম্যালাতে না ম্যালাতেই দেখি এডা গাড়ি হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়। অল্প থ্যাকেই জানে বাঁইচ্যা গেচি।’

ঘটনার সময় আওয়ামী লীগ নেতা আসিফ ইকবাল মদ্যপ ছিলেন কি না জানতে চাইলে ক্ষতিগ্রস্ত মফিজ শেখ এবং তাঁর পরিবারের কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। প্রতিবেশীরাও এ নিয়ে মুখ খুলছেন না।

সংস্কার করে দেওয়া ঘরের সামনে মফিজ শেখ
ছবি: প্রথম আলো

উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জাকারিয়া খোন্দকারের তত্ত্বাবধানে রাতারাতি ঘর মেরামত ও আসবাব কিনে দেওয়া হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা আসিফ ইকবাল মদ তো দূরের কথা, সিগারেটও খান না। আওয়ামী লীগের ভেতরে তাঁর বিরোধী একটি অংশ তাঁকে হেয় করতে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘এটা নিছক দুর্ঘটনা। তবু আমাদের নেতা আসিফ ইকবাল নিজ দায়িত্বে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর মেরামত করে দিয়েছেন। এ ছাড়া কিছু আসবাবও কিনে দেওয়া হয়েছে।’

জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি টি আই এম নুরুন্নবী তারিক বলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসিফ ইকবাল মদ্যপ ছিলেন কি না, সেটা তদন্তের বিষয়। তবে গভীর রাতে এভাবে তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি ঘুমন্ত কোনো ব্যক্তির ঘরে ঢুকে পড়া দলের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

ধুনট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রবিউল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনাবশত আসিফ ইকবালের গাড়ি সড়কের পাশে একটি বাড়িতে ঢুকে পড়ে। গৃহকর্তা ও তাঁর স্ত্রী চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এটি আসিফ ইকবালের ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল। আজ পর্যন্ত এ নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। চালকের আসনে কে ছিলেন, তাঁর কোনো গাফিলতি ছিল কি না, সেটা অভিযোগ পেলে তদন্ত করে দেখা হবে।