খুনিদের আড়াল করার অভিযোগ পরিবারের

দীপঙ্কর চক্রবর্তী

বগুড়ায় সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তী হত্যাকাণ্ডের দায় জঙ্গিদের ওপর চাপিয়ে প্রকৃত খুনিদের আড়াল করার অভিযোগ তুলেছে তাঁর পরিবার। পরিবারের অভিযোগ, তদন্তে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ গোঁজামিল দিয়ে হত্যার দায় জঙ্গিদের ওপর চাপিয়ে মামলার তদন্ত শেষ করেছে।

দীপঙ্কর চক্রবর্তীর স্ত্রী ও ছেলেরা প্রশ্ন তুলেছেন, মামলার দুজন তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, দীপঙ্কর চক্রবর্তী জঙ্গি নিয়ে কোনো লেখালেখি করেননি। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জঙ্গিদের কোনো সংশ্লিষ্টতাও মেলেনি। অথচ সেই পুলিশই পরে জঙ্গির ওপর দায় চাপিয়ে এই মামলার তদন্ত শেষ করেছে।

দীপঙ্কর চক্রবর্তী বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক দুর্জয় বাংলা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সহসভাপতি ছিলেন। ২০০৪ সালের ২ অক্টোবর রাত সাড়ে ১২টার দিকে বাড়িতে ফেরার সময় দুর্বৃত্তরা তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় তাঁর বড় ছেলে পার্থ সারথি চক্রবর্তী বাদী হয়ে শেরপুর থানায় অজ্ঞাত আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এরপর চার দফা তদন্তে কিছুই পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। এর মধ্য সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বগুড়ার জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে পুনঃ তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। তদন্ত করেন ডিবির উপপরিদর্শক মজিবর রহমান। থানা-পুলিশ, সিআইডি, ডিবি মিলিয়ে এ হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ১২ জন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়েছেন।

তদন্ত প্রতিবেদনমতে, হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা জেএমবির শুরা সদস্য সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই এবং শায়খ আবদুর রহমানের জামাতা আবদুল আওয়াল। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ ঝালকাঠির বিচারক হত্যা মামলায় ময়মনসিংহ কারাগারে এই দুজনের ফাঁসি কার্যকর হয়। মামলার আরেক আসামি জেএমবি নেতা ফজলে রাব্বী ওরফে সাজেদুর রহমান ২০১৫ সালের ২০ জুলাই গাইবান্ধার সাঘাটায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। আশুলিয়ায় র‍্যাবের অভিযানে পালাতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে নিহত হন জেএমবির প্রধান সারোয়ার জাহান মানিক। হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা পেলেও মৃত্যুর কারণে অভিযোগপত্র থেকে এই চার জঙ্গির নাম বাদ দেওয়া হয়। এ ছাড়া তদন্তে সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় সাত জঙ্গির নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়।

জঙ্গিরা হত্যা করলে হুমকি কেন দেবে? হত্যাকাণ্ডের আলামত হিসেবে ঘটনাস্থল থেকে রক্তমাখা চটের ব্যাগ, গামছা এবং সিগারেটের প্যাকেট উদ্ধার হয়েছিল। জঙ্গিরা কি সিগারেট খেত?
অঞ্জনা চক্রবর্তী, দীপঙ্কর চক্রবর্তীর স্ত্রী

২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ডিবি পুলিশ হোলি আর্টিজানে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীকে অভিযুক্ত করে বগুড়ার আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। কিন্তু সাড়ে তিন বছরেও একমাত্র আসামিকে আদালতে হাজির করতে না পারায় মামলার সাক্ষ্য গ্রহণই শুরু হয়নি। বর্তমানে মামলাটি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত-৩-এ বিচারাধীন রয়েছে।

বিচারের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বগুড়া আদালতের সরকারি কৌঁসুলি আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, মামলার একমাত্র আসামি জঙ্গিনেতা জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীকে আদালতে হাজির করে সাক্ষ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। সাক্ষ্য গ্রহণে আসামিকে হাজির করতে দফায় দফায় আদালত দিন ধার্য করলেও কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আসামিকে বগুড়ায় আনা সম্ভব হয়নি। আগামী ২১ নভেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য মামলার পরবর্তী দিন ধার্য আছে।

পরিবারের দাবি, তদন্ত ভুয়া

মামলার বাদী ও দীপঙ্কর চক্রবর্তীর ছেলে পার্থ সারথি প্রথম আলোকে বলেন, সঠিক তদন্তে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ একেক সময় একেক কল্পকাহিনি সাজিয়ে মামলা শেষ করতে চেয়েছে। থানা থেকে মামলার আলামত গায়েব করে; সর্বহারা, জাল টাকার কারবারি, জেএমবির সদস্যদের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে মামলার অনেক ক্ষতি করা হয়েছে। শেষে যেনতেনভাবে মামলা শেষ করতেই জঙ্গিদের ওপর দায় চাপিয়ে গোঁজামিল দিয়ে এই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে।

এলাকাবাসী জানিয়েছিলেন, হত্যাকাণ্ডের পর দুটি মোটরসাইকেলে খুনিরা পালিয়েছেন। অথচ জঙ্গিনেতা জাহাঙ্গীর আলম আদালতের স্বীকারোক্তিতে উল্লেখ করেছেন, হত্যাকাণ্ডের পর তাঁরা একটি মোটরসাইকেলে পালিয়েছেন।

দীপঙ্কর চক্রবর্তীর স্ত্রী অঞ্জনা চক্রবর্তী আক্ষেপ করে বলেন, হত্যার কয়েক দিন আগে থেকেই দীপঙ্করকে ফোনে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। হুমকি পেয়ে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, পেছনে শত্রু লেগেছে। অঞ্জনা চক্রবর্তী বলেন, ‘জঙ্গিরা হত্যা করলে হুমকি কেন দেবে? হত্যাকাণ্ডের আলামত হিসেবে ঘটনাস্থল থেকে রক্তমাখা চটের ব্যাগ, গামছা এবং সিগারেটের প্যাকেট উদ্ধার হয়েছিল। জঙ্গিরা কি সিগারেট খেত?’
অঞ্জনা চক্রবর্তী আরও বলেন, তাঁর (দীপঙ্কর) কোনো শত্রু ছিল না। জঙ্গিদের নিয়ে তিনি লেখালেখিও করেননি। দীপঙ্কর আওয়ামী লীগ করতেন। হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বিএনপির সরকারের সময়ে। তখন না হয় সঠিক তদন্ত হয়নি। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এসেও কেন সঠিক তদন্ত করল না? সরকার ইচ্ছে করলেই সুষ্ঠু তদন্ত করে অন্তত বিচারটা করতে পারত। করেনি। মামলা ডিসমিস আর প্রকৃত খুনিদের আড়াল করতেই জঙ্গি নাটক সাজিয়ে দায়সারা তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।

দীপঙ্কর চক্রবর্তীর ছোট ছেলে অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী বলেন, ‘জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীকে দিয়ে আরেকটি জজ মিয়া নাটক সাজাতেই তাঁকে দিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। লেখালেখির কারণে বাবার কোনো শত্রু ছিল না। তবে পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ নিয়ে অন্যদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল। এসব বিষয় মাথায় রেখে পিবিআই বা র‍্যাবকে দিয়ে মামলা পুনঃ তদন্তের আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত খুনিদের বাঁচাতে জঙ্গিদের ওপর দায় চাপিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।’

অনিরুদ্ধ বলেন, জঙ্গিরা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকলে টেলিফোনে হুমকি দিয়েছিলেন কারা? এলাকাবাসী জানিয়েছিলেন, হত্যাকাণ্ডের পর দুটি মোটরসাইকেলে খুনিরা পালিয়েছেন। অথচ জঙ্গিনেতা জাহাঙ্গীর আলম আদালতের স্বীকারোক্তিতে উল্লেখ করেছেন, হত্যাকাণ্ডের পর তাঁরা একটি মোটরসাইকেলে পালিয়েছেন।

জাহাঙ্গীরের জবানবন্দি

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, হোলি আর্টিজানে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী ২০১৭ সালের দিকে টাঙ্গাইলে গ্রেপ্তার হন। তাঁর বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার রাঘবপুর ভূতমারা গ্রামে। বগুড়ার পুলিশ দুটি জঙ্গিসংক্রান্ত মামলায় চার দফায় রিমান্ডে নিয়ে ২৮ দিন জিজ্ঞাসাবাদ করে। দীপঙ্কর হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ২০১৭ সালের ৬ মার্চ বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহসান হাবীবের (শেরপুর) কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন জাহাঙ্গীর।

জবানবন্দিতে জাহাঙ্গীর আলম উল্লেখ করেন, জেএমবির তৎকালীন শুরা সদস্য সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমানের জামাতা আবদুল আউয়ালের নির্দেশেই দীপঙ্কর চক্রবর্তীকে খুনের পরিকল্পনা করে জেএমবি। বাংলা ভাই ও জেএমবির তৎপরতা সম্পর্কে পত্রিকায় লেখালেখির কারণেই তাঁকে খুন করা হয়। লেখালেখিতে ক্ষুব্ধ হয়ে বাংলা ভাইয়ের নির্দেশে তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় জেএমবি।

স্বীকারোক্তিতে জাহাঙ্গীর আরও উল্লেখ করেন, ২০০১ সালে তিনি জেএমবিতে যোগ দেন। ২০০৪ সালে তিনি জেএমবির সদস্য সারোয়ার জাহান মানিকের নির্দেশে হিজরত করেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে গাইবান্ধার সাঘাটা থেকে সিরাজগঞ্জ যান। তাঁকে একটি মেসে রাখা হয়। সেখানে তিনি অন্য জেএমবি সদস্যদের সঙ্গে পরিচিত হন। দুই মাসের মাথায় তাঁর বগুড়ায় অপারেশনের ডাক পড়ে। ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে বগুড়া শহরের সরকারি আজিজুল হক কলেজের পেছন দিকে এক আস্তানায় আশ্রয় নেন তিনি। সেখানে নুরুল্লাহ, সানাউল্লাহসহ ১০-১২ জন জঙ্গির সঙ্গে পরিচয় হয়। পরদিন সেখানে জেএমবির অপারেশন কমান্ডার আবদুল আউয়াল আসেন। তাঁর নেতৃত্বে দীপঙ্কর হত্যাসংক্রান্ত বৈঠক হয়।

সে মোতাবেক দিনের বেলা শেরপুর রেকি করা হয়। তিনি মানুষের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পান। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী দীপঙ্করের ওপর হামলার পর তাঁরা আবার জঙ্গি আস্তানায় ফেরত যান। হত্যা মিশনে তিনি ছাড়াও সারোয়ার, সানাউল্লাহ ও নুরুল্লাহ অংশ নেন। জাহাঙ্গীরের দায়িত্ব ছিল গতিবিধি লক্ষ করা, আর হত্যার মূল দায়িত্বে ছিলেন সানাউল্লাহ ও নুরুল্লাহ। রাত ১২টায় দীপঙ্কর চক্রবর্তী বাস থেকে নেমে একটি হোটেলে চা পান করেন। পরে বাড়ির দিকে রওনা দিলে পিছু নেন। বাড়ির গেটের ঠিক সামনে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যার পর তাঁরা আবার জঙ্গি আস্তানায় ফেরত যান।