চট্টগ্রামে অস্ত্র-গুলিসহ শীর্ষ সন্ত্রাসী শহিদুল গ্রেপ্তার
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী শহিদুল ইসলাম ওরফে বুইস্যাকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গতকাল শনিবার রাতে নগরের দুই নম্বর গেট এলাকা থেকে র্যাব-৭-এর একটি দল তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
শহিদুলকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি র্যাব-৭ চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক (গণমাধ্যম) এ আর এম মোজাফফর হোসাইন প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র-গুলিসহ এই শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় সংবাদ সম্মেলন করে অভিযানের বিস্তারিত তুলে ধরা হবে বলে জানান তিনি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, চুরি, ছিনতাইয়ের মাধ্যমে অপরাধে হাতেখড়ি শহিদুলের। গায়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়ে জটলা পাকিয়ে লোকজনের জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিতেন। পরে তিনি জড়িয়ে পড়েন মাদকের কারবারে। নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। নগরের চান্দগাঁও-পাঁচলাইশ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নেতা হিসেবে পরিচিত তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই, অস্ত্র, চাঁদাবাজি, মাদকের অন্তত ২০টি মামলা রয়েছে। চাঁদাবাজি ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়ই প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। শহিদুলের এ ছাড়াও রয়েছে নিজস্ব ‘টর্চার সেল’। মাদক বিক্রি ও চাঁদাবাজির টাকা দ্রুত গুনতে রয়েছে গণনার যন্ত্র।
শহিদুল ভোলার দৌলতখান উপজেলা সদরের মোহাম্মদ আলীর ছেলে। পড়াশোনার তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সমাবেশে দলবল নিয়ে যোগদানের ছবি ও ভিডিও রয়েছে তাঁর। নিজেকে ওই সময় পরিচয় দিতেন নগর ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) নেতা হিসেবে। তবে কোনো পদে ছিলেন না।
চাঁদা না পেলেই গুলি
শহিদুল ও তাঁর বাহিনীর লোকজন চাঁদা না পেলেই গুলি ছোড়েন। গত ৪ অক্টোবর তাঁর সহযোগী মুন্না পাঁচলাইশ বাদুড়তলা এলাকায় একটি গ্যারেজের সামনে গুলি ছোড়েন। এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, বিজয় চৌধুরীর গ্যারেজের সামনে এসে মুন্না হুমকি দিতে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁর কোমর থেকে পিস্তল বের করে গুলি করতে থাকেন। তবে কেউ আহত হননি। পরে গ্যারেজের মালিকসহ আশপাশের লোকজন ‘ডাকাত’ ‘ডাকাত’ চিৎকার করলে মুন্না গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যান।
গত বছরের ১০ নভেম্বর চান্দগাঁও থানার পাশে একটি মোটর গ্যারেজে চাঁদা না পেয়ে গুলি করেন শহিদুল। গ্যারেজের মালিক মারুফ খান জানান, তাঁদের কাছে ফোন করে প্রথমে ২০ লাখ টাকা, পরে ১৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। কিন্তু চাঁদা না দেওয়ায় গুলি করা হয়েছে। একই বছরের ১৯ অক্টোবর শহিদুল ও তাঁর সহযোগীরা মনিরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে ছুরিকাঘাত করেন।
৩০ সদস্যের বাহিনী, রয়েছে বিদেশি অস্ত্র
পুলিশ-র্যাব জানায়, শহিদুল চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ এলাকায় ৩০ জনকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বাহিনী। এলাকায় মাদক, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে এই বাহিনী জড়িত। শহিদুলের সহযোগীদের মধ্যে ১৮ মামলার আসামি আইয়ুব আলী, ৯ মামলার আসামি মো. ইদ্রিস, ৫ মামলার আসামি মো. ইয়াসিন, ৪ মামলার আসামি শিবু এবং রাকিব, সবুজ, রাসেল, ইমন, কামরুল, হাফিজুল ইসলাম, মো. মুন্না, হাবিব, মুরাদ, আজিম, শাহাব উদ্দিন, হিরু, শাকিব, বোরহান উদ্দিন, মোহাম্মদ মারুফ, আল আমিন, মিজানুর রহমান, রোকন উদ্দিন, আলী আহাম্মদ, শান্ত মজুমদার, মো. অন্তর, বিরো পাল, মোহাম্মদ রাহাত ও মোহাম্মদ ফরহাদ রয়েছেন।
সন্ত্রাসী শহিদুলের কাছে কত অস্ত্র আছে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি পুলিশ। শেষ ৯ অক্টোবর বুইস্যার তাঁর তিন সহযোগীর কাছে থেকে ১৩টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, ১৩টি ম্যাগাজিন ও ৫৮টি বুলেট উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে গত ২০ জুলাই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শহিদুল ও তাঁর বাহিনীর প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর বেশ কয়েকজন সহযোগীর হাতে অস্ত্র দেখা যায়।
থানা থেকে লুট হওয়া গুলি ‘টর্চার সেলে’
নগরের চান্দগাঁও বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার এলাকার একটি ভবনের তৃতীয় তলার একটি বাসাকে ‘টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যবহার করতেন শহিদুল। গত ২১ জুলাই সেখানে অভিযান চালিয়ে তাঁর ১১ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে বেশ কিছু দেশি অস্ত্র, গুলি ও গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে থানা থেকে লুট হওয়া গুলি ও গুলির খোসা রয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
চান্দগাঁও থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফতাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জামিনে থাকা আরেক সন্ত্রাসী ইসমাইল হোসেন ওরফে টেম্পোর বাহিনীর সঙ্গে বুইস্যার বাহিনীর গোলাগুলি হয়। এরপর পুলিশ অভিযান চালিয়ে বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার এলাকায় সন্ত্রাসী শহিদুল ইসলামের আস্তানাটির সন্ধান পায়। সেখানে থানা থেকে লুট হওয়া দুটি গুলি ও গুলির খোসা পাওয়া গেছে। আফতাব উদ্দিন আরও বলেন, আস্তানাটিকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। যাঁরা এসব সন্ত্রাসীর চাহিদামতো চাঁদা কিংবা টাকা দিতেন না, তাঁদের সেখানে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। আস্তানায় প্লায়ার্স, রামদা, সিসিটিভি ক্যামেরাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম পাওয়া গেছে।
মেশিনে চাঁদাবাজির টাকা গণনা
গত ১০ অক্টোবর নগরের শুলকবহর এলাকায় অভিযান চালিয়ে শহিদুলের তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে একটি বাসার ভেতর থেকে মাদক, অস্ত্রের পাশাপাশি টাকা গণনার যন্ত্রও উদ্ধার করে। ব্যাংকে ব্যবহৃত এই যন্ত্র দিয়ে চাঁদা ও মাদক বিক্রির টাকা গোনা হতো বলে জানায় পুলিশ।