মনির ১০২ রূপে লিখতে পারেন

কুমিল্লার তিতাস উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক মো. মনির হোসেন সরকার ১০২ রূপে লিখতে পারেন। তিনি ছড়া–কবিতা লেখেন, উপস্থাপনা করেন, শখের বশে অভিনেতাও।

মনির হোসেন সরকার ১৩ বছরের সাধানায় বাংলা অক্ষরে ১০২ রূপে লিখতে পারার সাফল্য অর্জন করেছেনছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লার তিতাস উপজেলার জগতপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক মো. মনির হোসেন সরকার (৬৪)। তিনি বাংলা অক্ষরে ১০২ রূপে লিখতে পারেন। ১৩ বছরের সাধনায় তাঁর এ সাফল্য।

মনির ১৯৭৭ সালে এসএসসি পাস করেন। ভর্তি হন দাউদকান্দির গৌরীপুর মুন্সী ফজলুর রহমান সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে। তখন তিনি হাতের লেখা সুন্দর করার দিকে মনোযোগ দেন। প্রথমে বাংলা অক্ষরে তিন রকম রূপে জাতীয় সংগীতের লাইনগুলো লেখেন। আরও ভিন্ন ভিন্ন রূপে লেখার আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর।

১৯৮৫ সালে মনির হোসেন তিতাস উপজেলার জগতপুর সাধনা উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অনুশীলন করে ১০২ রকম রূপে লিখতে পারার দক্ষতা অর্জন করেন।

গল্পে গল্পে মনির জানান, স্কুলজীবনে তাঁর হাতের লেখা ভালো ছিল না। সে জন্য শিক্ষকদের কাছে তাঁকে বকা খেতে হতো। তখন কীভাবে লেখা ভালো করা যায়, সেই চিন্তা করতেন তিনি। কলেজে ভর্তির পর নিজেই লেখা ভালো করার জন্য অনুশীলন শুরু করেন। প্রথমে এসব লেখা দেখে বন্ধুরা তাঁকে পাত্তা দিতে চাইতেন না; কিন্তু তিনি অনুশীলন বন্ধ করেননি।

ধীরে ধীরে মনিরের সুনাম ছড়াতে থাকে। শুরু হয় অভিনন্দনপত্র, মানপত্র, শ্রদ্ধাঞ্জলি ও অন্যের হয়ে প্রেমপত্র লিখে দেওয়ার অনুরোধ। তখন তো আর এখনকার মতো স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে লেখার বিষয় ছিল না। তাই জেলা-উপজেলায় কোনো মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এলে তাঁর জন্য মানপত্র লিখে নিতে লোকজন তাঁর কাছ আসতেন।

মনির হোসেনের কথা হানিফ সংকেতের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’–তে তুলে ধরা হয়েছিল। সেটি ১৯৯৩ সালের ৩১ ডিসেম্বরের কথা। সেই অনুষ্ঠানে তাঁর লেখা চিঠি পড়ে শোনানো হয়। ৫৪ প্যাটার্নে তাঁর কিছু লেখাও প্রদর্শন করা হয়।

১৯৯৪ সালে ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে একটি প্রদর্শনীতে অংশ নেন মনির। সেটির নাম ছিল ‘বাংলা ভাষা ও বর্ণমালার ব্যবহার, অতীত-বতর্মান’। সেখানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের হাতের লেখার সঙ্গে মনির হোসেন সরকারের ৭৬টি রূপে লেখাও ছিল।

এসব অর্জনে মনির হোসেন উৎসাহিত বোধ করেন। ১৯৯৬ সালের বইমেলায় তিনি ৭৬ রূপে লেখা নিয়ে হস্তাক্ষর গাইড নামে একটি  বই বের করেন। ইচ্ছা আছে, বইটির নতুন সংস্করণ বের করার। এখানে তিনি ১০২ প্যাটার্নে বাংলা অক্ষরের লেখা রাখতে চান।

সুন্দর হাতের লেখার বিষয়ে জানতে চাইলে মনির হোসেন বলেন, ‘এখানে শৈল্পিকতাই মুখ্য। তবু যেহেতু আমরা বাংলাভাষী, সেহেতু আমাদের বাংলা লেখা অবশ্যই সুন্দর হওয়া দরকার। আর বাংলা লেখা সুন্দর হওয়ার মাধ্যমেই আমাদের দেশাত্মবোধ ও মমত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায়। আচার-অনুষ্ঠানে, চলায়-বলায়, পোশাকে-পরিচ্ছদে যদি বাঙালির স্বকীয়তার সত্তা খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে বাংলা লেখা কেন খুঁজবে না? এর কোনো বিকল্প নেই।’

মনিরের জীবনে আক্ষেপও আছে। শিল্পী হওয়ার জন্য তিনি ১৯৮০ সালে ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি; তবে থামেননি। 

দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় গিয়ে প্রধান শিক্ষকদের অনুমতি নিয়ে হাতের লেখার ক্লাস নিয়েছেন।

স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে মনির হোসেনের সংসার। সুন্দর করে লেখার পাশাপাশি উপস্থাপনা করেন, ছড়া ও কবিতা লিখেন। কুমিল্লার তিতাস, হোমনা, মুরাদনগর, দাউদকান্দি ও মেঘনা; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর; মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া; নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার ও সোনারগাঁয়ে কুস্তি খেলা উপস্থাপনা করে দর্শক মাতানোতে ওস্তাদ তিনি। বাউলগানের আসরে উপস্থাপনা করেন। ফুটবলের ধারাভাষ্যকার হিসেবেও তাঁর সুনাম আছে।

আমৃত্যু শিল্প–সংস্কৃতির সঙ্গে থাকতে চান মনির হোসেন। শিক্ষকতা, লেখালেখি, সুন্দর হাতের লেখা ও উপস্থাপনার পাশাপাশি তাঁর আরেকটি গুণও আছে। তিনি শখের বশে অভিনয় করেন। এখন পর্যন্ত ১৭টি সিনেমা ও ১টি টিভি নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন।