রাউজানে যুবদল নেতাকে গুলি করে পাহাড়ি পথে পালিয়ে যান বোরকা পরা সন্ত্রাসীরা
একজনের হাতে অগ্নেয়াস্ত্র। আরও চার পাঁচজন বোরকা পরা একটি অটোরিকশা থেকে এদিক–ওদিক হাঁটাহাটি করে আবার আরেকটি অটোরিকশায় উঠছে। মুখে সবারই মুখোশ পরা। পরে তাঁরা দ্রুত চলে যান পাহাড়ি পথে। চট্টগ্রামের রাউজানে যুবদল নেতাকে গুলি করে হত্যার পর এভাবেই চলে যেতে দেখা যায় সন্ত্রাসীদের। পাশের একটি বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজে এই দৃশ্য ধরা পড়েছে।
গতকাল রোববার দুপুরের দিকে আত্মীয়ের জানাজার নামাজ পড়া শেষে বাড়ি ফেরার পথে উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নের ইশান ভট্টের হাটে গুলি করে হত্যা করা হয় যুবদল নেতা মুহাম্মদ সেলিমকে। তিনি কদলপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের শমসেরপাড়া গ্রামের আমির হোসেনের ছেলে। তাঁর পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া এক ছেলে ও ১৮ মাস বয়সী এক মেয়ে রয়েছে। সেলিম বালুর ব্যবসা এবং মুরগি খামারি ছিলেন। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সেলিম ২০২২ সালে গঠিত কমিটিতে ইউনিয়ন যুবদলের সদস্যসচিব ছিলেন।
সেলিমকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় আজ সোমবার বেলা দুইটা পর্যন্ত মামলা হয়নি বলে জানিয়েছে থানা পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আতঙ্কিত পরিবারের সদস্যরা মামলার সাহস পাচ্ছেন না বলে স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বজনদের সূত্রে জানা গেছে। পাশাপাশি সেলিমের স্ত্রী ঘটনার পর থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
কী কারণে সেলিমকে খুন করা হয়েছে, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না পুলিশ। তবে রাজনৈতিক ও নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এ ঘটনা পারে বলে ধারণা পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের। সন্ত্রাসীদের বহনকারী সিএনজিচালিত এক অটোরিকশার চালককে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তেমন কোনো তথ্য তাঁরা জানতে পারেনি। হত্যার ঘটনায় সাত থেকে আটজন অংশ নেন বলে পুলিশ নিশ্চিত হতে পেরেছে। তবে তাঁদের কাউকে আটক করাও সম্ভব হয়নি।
এদিকে যুবদল নেতা সেলিমকে গুলি করে হত্যার পর সন্ত্রাসীদের চলে যাওয়ার একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব ফুটেজে দেখা যায়, বোরকা পরা এবং মুখোশধারী সাত থেকে আটজন সন্ত্রাসীকে কদলপুর ইশান ভট্টের হাট হয়ে ভোমরপাড়া হজরত আশরাফ মাজারের ফটকে একটি অটোরিকশা থেকে অস্ত্রহাতে নামতে দেখা যায়। পরে সেখান থেকে আরেকটি অটোরিকশা পাল্টে প্রকাশ্যে হজরত আশরাফ শাহ মাজার সড়ক ধরে পাহাড়ি এলাকার দিকে যেতে দেখা যায়। সশস্ত্র এসব ব্যক্তিকে দেখে পালাতে দেখা যায় আশপাশের লোকজনকে।
পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করে আসামিদের শনাক্তের প্রক্রিয়া চলমান। এর মধ্যে তিন–চারজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। গতকাল রাতে এবং আজ ভোর থেকে পাহাড়ি এলাকার সন্ত্রাসী আস্তানায় অভিযান চালানো হয়েছে। তবে সন্ত্রাসীরা বারবার স্থান পরিবর্তন করছে, এ কারণে তাঁদের ধরা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তিন চারজন খুনিকে শনাক্ত করতে পেরেছি। তাঁদের একজন সন্ত্রাসী মুহাম্মদ রায়হান। রায়হান ৫ আগস্টের পর তাঁর নিজ এলাকা রাউজান সদর ও কদলপুরে একাধিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়ান। সেলিমকেও আধিপাত্য বিস্তারের জের ধরে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে সেলিমের স্ত্রী অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় এখনো মামলা করেননি। তবে শিগগির মামলা করে আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।’
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, খুনের পর হত্যাকারীরা যেভাবে এলাকা ছেড়েছেন তাতে মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সেলিম হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা কেউ নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে চাননি। তাঁরা বলছিলেন, সেলিমের বিরুদ্ধেও নানা অপরাধ ও রাজনৈতিক মামলা রয়েছে। তিনি বালু, মাটি ও পাহাড়ি ব্যবসা–বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। আবার হত্যাকারী সন্ত্রাসীরাও ওসব ব্যবসায় জড়িত। আধিপত্য বিস্তার থেকে এ হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে বলে তাঁদের ধারণা।
পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, রাউজানে গত ১৮ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ১০টি রাজনৈতিক হত্যা, অর্ধশত বার গোলাগুলি, সংঘর্ষ, মারামারি এবং কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে বিএনপির স্থানীয় দুটি পক্ষের দ্বন্দ্বের জের ধরে এসব ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি পুলিশের। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৫টিরও বেশি।