জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণের তোড়জোড়

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে তোলাছবি: প্রথম আলো

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১২টি স্থাপনার কাজ চলছে। ইতিমধ্যে ছয়টি ১০ তলাবিশিষ্ট হলের নির্মাণকাজ শেষ। এসব ভবন বানাতে গিয়ে হাজারের বেশি গাছ কেটেছে প্রশাসন।

মহাপরিকল্পনা ছাড়াই যত্রতত্র গাছ কেটে ভবন না করতে কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। এর মধ্যে এবার জলাশয় ভরাট করে গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের সম্প্রসারিত ভবন নির্মাণের তোড়জোড় শুরু করেছে প্রশাসন।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, মহাপরিকল্পনার তোয়াক্কা না করে প্রশাসন নির্বিচার গাছ কেটে যত্রতত্র ভবন নির্মাণের পর এবার জলাশয়ের দিকে নজর দিয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে। জলাশয় ভরাট করে ভবন বানালে নতুন সংকট তৈরি হবে। অন্যদিকে কর্তৃপক্ষ বলছে, ভবন নির্মাণের জায়গাটি জলাশয় নয়; বরং নিচু জমি। যদিও জলাশয় হওয়ায় ২০১৭ সালে সেখানে আরেকটি ভবন নির্মাণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ মার্চ পদার্থবিজ্ঞান ভবন এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে যাওয়ার রাস্তার পাশে জলাশয়ে গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের সম্প্রসারিত ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম। সেখানে ৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ছয় তলাবিশিষ্ট ১ লাখ ৩০ হাজার বর্গফুটের ভবন নির্মাণ করা হবে। একই দিন দুপুরে ‘মহাপরিকল্পনা ছাড়া কোনো ভবন করতে দেওয়া হবে না’ জানিয়ে মানববন্ধন করেন ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের নেতা-কর্মীরা। এরপর নানা কর্মসূচি পালন করেছেন আন্দোলনকারীরা; কিন্তু আন্দোলনের তোয়াক্কা না করে জলাশয়ে ভবন নির্মাণ শুরু করেছে প্রশাসন।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের শেষে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরির ঘোষণা দিয়েছিলেন উপাচার্য মো. নূরুল আলম। একটি টেকনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট কমিটিও (টিএমসি) করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি বাস্তবায়নের আগে কয়েকটি স্থাপনা নির্মাণের আয়োজন করেছে কর্তৃপক্ষ।

ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের (একাংশ) সভাপতি অমর্ত্য রায় বলেন, জলাশয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববৈচিত্র্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান। প্রতিবছর ক্যাম্পাসে অতিথি পাখি আসে। জলাশয়ে অনেক প্রাণী বাস করে। জলাশয় ভরাট করে ভবন বানালে প্রশাসন আইন লঙ্ঘন করবে। অনেকবার এসব উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রশাসন অন্ধ হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে প্রশাসনকে অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হবে। মহাপরিকল্পনা ছাড়াই প্রশাসন যেখানে-সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করে চলেছে।

৭ মে সরেজমিনে দেখা গেছে, জায়গাটি চারপাশে টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা। জলাশয়ে খননযন্ত্র দিয়ে কচুরিপানা সরিয়ে সেচপাম্প দিয়ে পানি সেচা হচ্ছে। জলাশয়ের ঠিক পাশেই আছে একটি আবহাওয়া স্টেশন, পরিবেশবিজ্ঞান, ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞানসহ কয়েকটি বিভাগের ভবন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে ওই জলাশয় ভরাট করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটি ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করা হয়েছিল। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণ না করতে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে চিঠি দেন পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আমির হোসেন ভূঁইয়া। পরে অধ্যাপক আমিরের সূত্র ধরে ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞানসহ কয়েকটি বিভাগ উপাচার্যের কাছে আলাদা আলাদা চিঠি দেন। এরপর অনানুষ্ঠানিকভাবে ভবন নির্মাণ স্থগিত করে প্রশাসন। গত বছরের শেষে অন্য স্থানে আইআইটি ভবনের কাজ শুরু হয়। এরপর চলতি বছরের মার্চে নতুন করে ওই জলাশয়ে গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের সম্প্রসারিত ভবন নির্মাণের আয়োজন শুরু করে প্রশাসন।

জলাশয়ে ভবন হলে জায়গায় জায়গায় জলাবদ্ধতা হবে। জলাশয়টি ক্যাম্পাসের রেজিস্ট্রার ভবনের সামনের লেক থেকে জয়পাড়া লেকের একটা সংযোগস্থল। এটি নষ্ট হলে পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
মোহাম্মদ আমির হোসেন ভূঁইয়া, অধ্যাপক

গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের ডিন অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ওটা জলাশয় নয়। ওটা কিছুটা নিচু জায়গা। বিজ্ঞান অনুষদের সব শিক্ষকের মতামতের ভিত্তিতে সেখানে ভবন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওখানে ভবন করা হলে পাশের আবহাওয়া স্টেশনের কার্যক্রমে কোনো ক্ষতি হবে না।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ। জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, কেউ আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি আইন অমান্যকারীর নিজ খরচে সেটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার বিধানও আছে।

প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নাসির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে জায়গায় কাজ শুরু হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকেরা সেটি জলাশয় হিসেবে ট্রিট করছেন কি না, সেটি দেখার বিষয়। তারা জায়গাটি লো-ল্যান্ড (নিচু ভূমি) হিসেবে দেখছেন। আমরা প্রকল্প অফিসও লো-ল্যান্ড হিসেবে বিবেচনা করেছি। এখন ওই জায়গা জলাশয় নাকি লো-ল্যান্ড, সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকেরা ভালো বলতে পারবেন। প্রশাসন আমাদের যে জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছে, আমরা সেখানে ভবন করছি।’ আইআইটি ভবন নির্মাণ স্থগিতের ব্যাপারে তিনি বলেন, জলাশয় হওয়ায় আইআইটি ভবন হয়নি এমন তথ্য তিনি জানেন না। তৎকালীন উপাচার্যের কাছে চিঠি দেওয়ার কারণে স্থগিত হয়েছে কি না, তা-ও জানেন না।

উপাচার্য মো. নূরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওটা জলাশয় না। ওখানে ১৯৮১ সালের দিকে একটি ভবন করতে ফাউন্ডেশনও করা হয়েছিল। বাজেটের কারণে পরবর্তী সময়ে আর হয়নি। ওখানে রড-পিলারও ছিল। কেউ হয়তো কেটে নিয়ে যেতে পারে। সাবেক উপাচার্যের সময় কী হয়েছিল, আমি জানি না। তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না।’

অধ্যাপক মোহাম্মদ আমির হোসেন ভূঁইয়ার ভাষ্য, জলাশয়ে ভবন হলে জায়গায় জায়গায় জলাবদ্ধতা হবে। জলাশয়টি ক্যাম্পাসের রেজিস্ট্রার ভবনের সামনের লেক থেকে জয়পাড়া লেকের একটা সংযোগস্থল। এটি নষ্ট হলে পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে।