পাকিস্তানি বাহিনীর পলায়ন, চাঙা হন মুক্তিযোদ্ধারা

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল মার্চে। এরপর ছোট-বড় অসংখ্য যুদ্ধে রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে ডিসেম্বরে আসে বিজয়। প্রতিরোধের সেই লড়াই নিয়ে এ আয়োজন। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কাউতলীতে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর পাশে একাত্তরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলকছবি : প্রথম আলো

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় অবস্থানগত কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ফলে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনী—উভয়েই জেলাটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে মরিয়া ছিল। মুখোমুখি হয়েছিল ছোট-বড় অনেকগুলো যুদ্ধের। 

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান (দ্বিতীয় খণ্ড) বইয়ে বলা হয়েছে, অবস্থান ও কৌশলগত কারণে মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই জেলার সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরার সীমান্ত আছে, আগরতলা থেকে সহজেই কসবা বা আখাউড়া দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ কিংবা কুমিল্লা হয়ে ঢাকার দিকে যাওয়া যায়। 

একই বইয়ে বলা হয়েছে, ২৭ মার্চ সকালে ওয়াপদা অফিসে মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে। খবর পেয়ে মেজর খালেদ মোশাররফও দ্রুত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে আসেন। জেলাজুড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি হয়। ২৮ মার্চ একদল পাকিস্তানি সৈন্য শহরে তথ্য সংগ্রহের জন্য এলে আক্রমণ করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন নিহত হন। 

একই বইয়ে আরও বলা হয়েছে, ২৯ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মেজর খালেদ মোশাররফের অগ্রবর্তী দলের কোম্পানীগঞ্জে লড়াই হয়। পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে চলে যায়। এই দিন জেলায় প্রথম বিমান হামলা করে পাকিস্তানি বাহিনী। 

গতিধারা প্রকাশিত বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়দুল হোসেনের মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বইয়ে আছে, মে মাসে পাকিস্তানি বাহিনী জেলার কসবার বিভিন্ন স্থানে শক্তিশালী ঘাঁটি বানায়। ২৫ থেকে ২৭ মে সালদা নদী এলাকায় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর ২৪ জন নিহত হন। এ ছাড়া ২৩-২৮ জুন কসবার চন্দ্রপুর, লতুয়ামোড়ায়, মন্দভাগ, তুলাইশিমুল ও নয়নপুর; ১২ জুলাই মন্দভাগ বাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড লড়াই হয়। ১৩-৩১ জুলাই কসবার সালদা নদী, কাশিমপুর সেতু, মনোরা রেলসেতু, কল্যাণসাগর, নোয়াগাঁও ও গোসাইল এলাকায় তীব্র লড়াই, গোলাগুলি ও প্রতিরোধে ১৪৪ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হন। 

একই বইয়ে জয়দুল হোসেন লিখেছেন, ‘দখলদার বাহিনী পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন উপজেলায় নির্মম ও বর্বরোচিত অত্যাচার, নির্যাতন ও গণহত্যা চালিয়েছে।’

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ২) বইয়ে বলা হয়েছে, পাকিস্তানি বাহিনী কসবার মন্দভাগ রেলস্টেশন এলাকায় শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। ৩০ জুন সকালে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে আক্রমণ চালান। পাঁচ ঘণ্টার যুদ্ধ শেষে দুপুর ১২টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী মন্দভাগ রেলস্টেশন ছেড়ে পালিয়ে যায়। চেষ্টা করেও পাকিস্তানি বাহিনী সেটি আর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি। 

কসবা, সালদা নদীসহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস বইয়ে উল্লেখ আছে, মিত্রবাহিনী, ‘কে’ ফোর্স ও মুক্তিযোদ্ধারা ১৩ নভেম্বর ভোরে সালদা নদী ঘিরে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী প্রতিরক্ষাঘাঁটিতে আক্রমণ করে। একপর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী টিকতে না পেরে গোলাবারুদ রেখে রেললাইন ধরে পালিয়ে যায়। এই সংবাদে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙা হয়। মুক্তিকামীরা দাঁড়িয়ে গুলি করতে করতে সামনে এগিয়ে যান।

২২ নভেম্বর সারা রাত কসবার চন্দ্রপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে গুরুতর আহত হন কসবার গোপীনাথপুরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মো. আসাদুজ্জামান খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চন্দ্রপুরে ৫০০ থেকে ৬০০ পাকিস্তানি সেনা ছিল। তাদের থেকে ২০ থেকে ৩০ গজ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমরা আক্রমণ করি।’ 

এমন ছোট–বড় যুদ্ধ, হারানো ও প্রাপ্তির গল্পে রচিত বাংলাদেশের বিজয়ের গল্প।