‘হাসিমুখে বিদায় নিয়া তারা আর ফিরি আইলো না’

সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের তিন সদস্যকে হারিয়ে কেঁদেই চলছে স্বজনেরা। আজ দুপুরে মৌলভীবাজারের কুচাই ফাঁড়ি চা-বাগান এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

‘আমার শাশুড়ি অসুস্থ। খবর পাইয়া বাবা, মা, জেঠা, ভাই তারে দেখতে গেল। শাশুড়ি আর নিজের শরীরের খেয়াল রাখতে বলল তারা। হাসিমুখে বিদায় নিয়া তারা আর বাড়ি ফিরি আইলো না।’ সড়ক দুর্ঘটনায় স্বজনদের হারিয়ে কেঁদে কেঁদে এ কথা বলছিলেন নিহত দীনবন্ধু মুন্ডার একমাত্র মেয়ে সকিনা মুন্ডা (২০)।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের রাধানগর চা-বাগানে তাঁর শ্বশুরবাড়ি। দুর্ঘটনায় খবর পেয়ে আজ সোমবার সকালে সকিনা বাবার বাড়িতে ছুটে আসেন। দুর্ঘটনায় সকিনার বাবা দীনবন্ধু মুন্ডা (৫৫), বড় ভাই পূজন মুন্ডা (৩৫) ও চাচা রবীন্দ্র মুন্ডা (৬০) মারা যান। এ ছাড়া আরেক চাচা গোপাল মুন্ডা (৬৫), মা কবিতা মুন্ডা (৫০) ও তাঁদের বহনকারী অটোরিকশাচালক আমির উদ্দিন (২৪) গুরুতর আহত হন।

সরেজমিনে আজ দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, জুড়ী-লাঠিটিলা সড়কের পাশে কিছু কাঁচা রাস্তা হেঁটে কুচাই ফাঁড়ি বাগানের একটি টিলার ওপর দীনবন্ধুদের বাড়ি। পাশাপাশি দুটি কাঁচা বসতঘর। বাড়িতে লোকজনের জটলা। ঘরের বারান্দায় বসে স্বজনেরা বিলাপ করে যাচ্ছেন। প্রতিবেশীরা তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

নিহত দীনবন্ধুর তিন ছেলে ও এক মেয়ে। পূজন ভাইদের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন।
দীনবন্ধুর বড় ছেলে অর্জুন মুন্ডা বললেন, ‘কাল (রোববার) রাইতে দুর্ঘটনার খবর পাই। কুলাউড়ায় হাসপাতালে গিয়া দেখি, ভাইয়ের (পূজন) লাশ রাখা। পরে খবর পাইলাম, বাবা (দীনবন্ধু), জেঠাও (রবীন্দ্র মুন্ডা) নাই। ডাক্তার বলেছেন, মায়ের (কবিতা মুন্ডা) অবস্থাও ভালা না। ঘরটা খালি হই গেল। আমরা কী করে মনটারে সান্ত্বনা দিই।’ এ কথা বলে তিনিও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন।

দীনবন্ধুদের পাশঘেঁষা আরেকটি টিলায় রবীন্দ্র মুন্ডার বাড়ি। স্বামীর মৃত্যুর খবর জানার পর তাঁর (রবীন্দ্র) স্ত্রী রাইমা মুন্ডা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। তাঁদের চার ছেলে ও দুই মেয়ে।
এদিকে দুপুরের দিকে উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান কিশোর রায় চৌধুরী, উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সানজিদা আক্তার, উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মিজানুর রহমান ও স্থানীয় গোয়ালবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল কাইয়ূম নিহত ব্যক্তিদের বাড়িতে যান। তাঁরা পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেন। পরে নিহত ব্যক্তিদের সৎকারের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩০ হাজার টাকা স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

উপজেলা চেয়ারম্যান কিশোর রায় চৌধুরী বলেন, ‘দুর্ঘটনায় একই পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। দ্রুত ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনেরা যাতে লাশ বুঝে পান, আমরা সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলী মাহমুদ বিকেল চারটার দিকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ময়নাতদন্তের জন্য নিহত দুজনের লাশ মৌলভীবাজার জেলা সদরে অবস্থিত ২৫০ শয্যার হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। আর অপরজনের লাশের ময়নাতদন্ত সিলেটের ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালের মর্গে সম্পন্ন হবে।

ওসি বলেন, কাভার্ড ভ্যান জব্দ করা হয়েছে। তবে চালক পালিয়ে গেছেন। এ ব্যাপারে থানায় মামলা হবে।

গত রোববার সন্ধ্যা সাতটার দিকে কুলাউড়া উপজেলার আছুরিঘাট এলাকায় মৌলভীবাজার-বড়লেখা আঞ্চলিক মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও কাভার্ড ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে অটোরিকশাটি দুমড়েমুচড়ে যায়। পূজন মুন্ডা ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরে স্থানীয় লোকজন ছুটে গিয়ে গাড়ির ভেতরে আটকা পড়া হতাহত ব্যক্তিদের টেনে বের করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠান। অবস্থার অবনতি ঘটায় আহত ব্যক্তিদের মৌলভীবাজার সদর ও সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে যাওয়ার পথে দীনবন্ধু ও রবীন্দ্র মারা যান।
এ নিয়ে আজ সকালে প্রথম আলোর অনলাইনে ‘অসুস্থ আত্মীয়কে দেখে ফেরার পথে প্রাণ গেল একই পরিবারের তিনজনের’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।