মনিরামপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক–সংকট, সেবা ব্যাহত

৫০ শয্যার এই হাসপাতালের ২২টি পদের মধ্যে ৯টি শূন্য। এর মধ্যে মেডিসিন ও কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোও রয়েছে।

যশোরের মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মহিলা ওয়ার্ড। সম্প্রতি তোলা ছবি
প্রথম আলো

‘আমার এক মাস ধরে জ্বর। আগে একবার এখানে ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার রক্ত ও প্রস্রাবের পরীক্ষা দিয়েছেন। হাসপাতালে পরীক্ষা করা যায়নি। ২০০ টাকা দিয়ে বাইরে থেকে এসব পরীক্ষা করিয়েছি। ডাক্তাররে সেই স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাগজ দেখানোর জন্য ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে প্রায় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু ডাক্তাররে পাইনি। এখানে ঠিকমতো ডাক্তার পাওয়া যায় না।’

সম্প্রতি যশোরের মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে এসে এসব কথা বলেন সদর আলী বিশ্বাস নামের এক রোগী। তাঁর বাড়ি মনিরামপুর উপজেলার মুন্সী খানপুর গ্রামে। চিকিৎসক–সংকটে শুধু সদর আলীই নন, উপজেলার অনেক রোগীই মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে যথাযধ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না। মেডিকেল টেকনোলজিস্টের অধিকাংশ পদ শূন্য থাকায় অনেক পরীক্ষাই রোগীদের বাইরে থেকে করাতে হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত টাকা খরচের পাশাপাশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন রোগীরা।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৭ সালে মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২১ সালে ৩১ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু আধুনিক ভবন নির্মাণ করা হয়নি। পুরোনো ভবনে চলছে চিকিৎসা কর্যক্রম। প্রতিদিন এখানে বহির্বিভাগে ৩০০ থেকে ৩৫০ জন রোগী চিকিৎসা নেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে আরও জানা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে ৪৮ হাজার ৭৪৩ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। একই সময়ে অন্তর্বিভাগে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫ হাজার ৯০৭ জন।স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে প্রতিদিন ৩৩ থেকে ৩৫ জন রোগী ভর্তি থাকেন। এ সময় ৬৩ জন গর্ভবতীর অস্ত্রোপচার হয়েছে। ওই ছয় মাসে এখানে ৩৮ জন রোগীর জটিল এবং ৪৯৪ জন রোগীর সাধারণ অস্ত্রোপচার হয়েছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এখানে চিকিৎসকের ২২টি পদ থাকলেও কর্মরত আছেন ১৩ জন। এর মধ্যে তিনজন যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে সংযুক্ত হয়েছেন। কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞের ১০টি পদের মধ্যে পাঁচটি শূন্য। আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তার (আরএমও) পদটিও শূন্য রয়েছে। নার্স ২৫ জনের মধ্যে ২৪ জন আছেন।

মেডিকেল টেকনোলজিস্টের (ল্যাব) তিনটি পদের মধ্যে দুটি এবং মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিওগ্রাফি), মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ডেন্টাল), মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ইপিআই) একটি করে পদের সব কটিই শূন্য। তৃতীয় শ্রেণির পদ ১১১টি থাকলেও সেখানে কর্মরত আছেন ৫৬ জন এবং চতুর্থ শ্রেণির ১৯টি পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৮ জন। বাকি ১১টি পদ দীর্ঘদিন থেকে শূন্য।

চিকিৎসকেরা বলছেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক–সংকট রয়েছে। যে কারণে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে তাঁদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর মধ্যে চক্ষু, নাক, কান, গলা (ইএনটি), মেডিসিন, চর্ম ও যৌন, অর্থোপেডিকস ও কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞের পদগুলো শূন্য থাকায় সেবা ব্যাহত হচ্ছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন প্রয়োজন।

সম্প্রতি দুবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অবস্থান করে দেখা যায়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মূল ফটক পেরিয়ে কিছুটা সামনে বহির্বিভাগের রোগীদের দীর্ঘ সারি। পাশে বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নার, প্রতিবন্ধী কর্নার, কিশোর–কিশোরী কর্নার ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী কর্নার। রোগীরা আসছেন, লাইনে দাঁড়িয়ে ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটছেন। এরপর চিকিৎসকের কক্ষের সামনে অপেক্ষা করছেন। ফটকের বাইরের দিকে ওষুধ কাউন্টার থেকে ওষুধ নিয়ে বাড়ি ফিরছেন কয়েকজন রোগী।

চিকিৎসকের কক্ষের সামনে অপেক্ষমাণ উপজেলার গোপালপুর গ্রামের গৃহবধূ মনোয়ারা বেগম (৬০) বলেন, ‘তিন মাস আগে পায়ে ঘা হয়েছিল। তখন এখানে এসে ডাক্তার দেখিয়ে গিয়েছিলাম। এখন ঘা একটু কমেছে। আবার ডাক্তার দেখাতে এসেছি। টিকিট কেটে এক ঘণ্টা ধরে বসে আছি। এখনো ডাক্তার দেখাতে পারিনি।’

উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের কৃষক আবদুল করিম বলেন, ‘শারীরিক সমস্যা নিয়ে সকালে হাসপাতালে এসে ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা দিয়েছেন। পরীক্ষার কাগজপত্র নিয়ে ঘণ্টাখানেক ধরে দাঁড়িয়ে আছি। এখনো সিরিয়াল পাইনি।’

ব্যবস্থাপত্র ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পাওয়া ওষুধ হাতে নিয়ে চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মোহনপুর গ্রামের জ্যোৎস্না দে (৭০)। তিনি বলেন, ‘প্রতি মাসে একবার এখানে ডাক্তার দেখাতে আসি। আজ ডাক্তার ২০ দিনের ওষুধ লিখে দিয়েছেন। হাসপাতাল থেকে ওষুধ পেয়েছি। কিন্তু ওই ওষুধ কীভাবে খেতে হবে, ডাক্তার তা লিখে দেননি। এ জন্য ডাক্তারের জন্য অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি।’

মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তন্ময় বিশ্বাস বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে দুই বছর আগে। সে অনুযায়ী চিকিৎসক পাওয়া যায়নি। চিকিৎসক–সংকটের কারণে ভালোভাবে রোগীর সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শূন্য পদে চিকিৎসক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে নিয়মিত সিভিল সার্জনের কাছে তিনি চিঠি পাঠাচ্ছেন।