দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে তিন বছর পরও হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি 

২০১৪ সাল থেকে এই বিভক্তি স্পষ্ট হয়। জেলার সভাপতি শেখ হারুনুর রশিদ ও সম্পাদক মোস্তফা রশিদীর দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়ে উপজেলাতেও।

খুলনা জেলার মানচিত্র

খুলনার পাইকগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি এখন দুই ভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে এক পক্ষের নেতৃত্বে সভাপতি আনোয়ার ইকবাল (মন্টু) ও অন্যপক্ষের নেতৃত্বে সাধারণ সম্পাদক শেখ কামরুল হাসান (টিপু)। দুই পক্ষের বিভক্তির কারণে সম্মেলনের তিন বছর পার হয়ে গেলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। কোনো ওয়ার্ড ও ইউনিয়নেও কমিটি গঠন করতে পারেননি তাঁরা। আনোয়ার ইকবাল বর্তমানে পাইকগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।

পাইকগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের এই দ্বন্দ্ব বেশ পুরোনো। বিশেষ করে ২০১৪ সাল থেকে এই বিভক্তি আরও স্পষ্ট হয়। ওই সময় জেলার সভাপতি শেখ হারুনুর রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম মোস্তফা রশিদীর দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়ে পাইকগাছা উপজেলাতেও। ভাগ হয়ে যায় দুটি পক্ষ। বিভিন্ন কর্মসূচিও আলাদা আলাদাভাবে পালন করতে থাকেন নেতা-কর্মীরা। ওই বছরের ২৬ অক্টোবর উপজেলার আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হলে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসে। এরপর ওই উপজেলার দুই গ্রুপের মধ্যে কয়েকবার মারামারির ঘটনাও ঘটে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে মারা যান মোস্তফা রশিদী। ২০১৯ সালের নভেম্বরে সর্বশেষ সম্মেলনের মাধ্যমে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হলেও নেতা-কর্মীদের মধ্যে আগের সেই বিভক্তি এখনো রয়ে গেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ কামরুল ইসলাম বলেন, ‘সভাপতি হলেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। দল নিয়ে তাঁর খুব বেশি ভাবনা নেই। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে কয়েকবার আলোচনা করা হয়েছে, কিন্তু তিনি তাতে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেননি। মূলত তিনি চান বিএনপি ও জামায়াত থেকে অনুপ্রবেশকারীদের কমিটিতে পদ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু একজন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়ে আমি তা মেনে নিতে পারি না।’

অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ওই দ্বন্দ্ব জিইয়ে রেখেছেন। তাঁরা দুই গ্রুপকে আলাদা আলাদাভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। আর দুই পক্ষের এই দ্বন্দ্বের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দল।

দলীয় নেতা-কর্মীদের সূত্রে জানা গেছে, সম্মেলন হওয়ার তিন বছর পরও কমিটি গঠিত না হওয়ায় গত বছরের ১৭ জুলাই জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাইকগাছা উপজেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে ১৯ জুলাই দুপুরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা জেলা কমিটির কাছে জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়। তবে ওই সময়ের মধ্যে শুধু সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত একটি চিঠি জেলা কমিটির কাছে জমা পড়ে। পরে গত ২৪ জানুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় পাইকগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি নিয়ে আলোচনা হয়। সে দিনই সভাপতি আনোয়ার ইকবাল আরও একটি কমিটির তালিকা জমা দেন। এরপর ওই কমিটি গঠনের কার্যক্রম সেভাবেই রয়েছে।

উপজেলা ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ পর ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর সর্বশেষ পাইকগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে নাম ঘোষণা করা হয় আনোয়ার ইকবালের। এর আগে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। আর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা করা হয় শেখ কামরুল হাসানের নাম। এ ছাড়া সহসভাপতি পদে উপজেলা পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি সমীরণ সাধু ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আনন্দ মোহন বিশ্বাসের নাম ঘোষণা করা হয়। ওই সম্মেলনের কয়েক মাস পর থেকেই দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েন দলটির নেতা-কর্মীরা।

নেতা-কর্মীরা জানান, আনোয়ার ইকবালের সঙ্গে থাকা নেতা-কর্মীরা মূলত ওই এলাকার (খুলনা-৬ আসন) সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামানের অনুসারী। তাঁর সঙ্গে সহসভাপতি ও যুগ্ম সম্পাদকও রয়েছেন। আর সংসদ সদস্যের বিরোধীরা যুক্ত কামরুল ইসলামের সঙ্গে। উপজেলা ও তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা মূলত কামরুল ইসলামের অনুসারী।

বিভক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার ইকবাল বলেন, উপজেলায় আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। করোনাসহ বিভিন্ন কারণে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে দেরি হয়েছে। তবে জেলার নেতাদের কাছে দুটি পূর্ণাঙ্গ কমিটির নামের তালিকা পাঠানো হয়েছে। বর্তমান কমিটি গঠনের ভার জেলার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। জেলার নেতারা যেভাবে কমিটি গঠন করবেন, সেভাবেই তা মেনে নেওয়া হবে।

কেন এই বিভক্তি, জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনন্দ মোহন বিশ্বাস বলেন, মূলত নিজেদের বলয়ের লোক ভারী করতেই এই দ্বন্দ্ব। এর বাইরে আর কিছু নয়। তবে নিজেদের দ্বন্দ্বের কারণে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিপক্ষ পার্টি সুবিধা নিচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দলে থাকলেও দলের কোনো কার্যক্রমে আমাদের ডাকা হয় না। এমনকি কমিটি গঠনের ব্যাপারেও কেউ আমাদের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা করেননি। নিজেরা নিজেদের অনুসারীদের পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে জেলার কাছে পাঠিয়েছেন বলে জানতে পেরেছি।’