‘প্রাণটা হাতে নিয়ে সাগরে যাই’

ঝড়ের কবলে পড়ে ফিরে আসা জেলে আবু বকর
ছবি: প্রথম আলো

পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার ঢেপসাবুনিয়া গ্রামের জেলে আবু বকরের মাছ ধরার ট্রলারটি ঝড়ের কবলে পড়ে ভারতের জলসীমানা পেরিয়ে তালপট্টি চলে গিয়েছিল। ঝড়ের সঙ্গে ১৯ ঘণ্টা লড়ে ১৩ জেলেসহ আবু বকরের ট্রলারটি তিন দিন পরে নিরাপদে বাড়ি ফিরেছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যাওয়া এফবি ভাইবোন ট্রলারের দুই যাত্রীকে।

২৩ আগস্ট বিকেলে আবু বকর (৪০) সাগরে মাছ ধরা প্রসঙ্গে বললেন, ‘প্রাণটা হাতে নিয়ে সাগরে যাই। ২২ বছর বয়স ধরে সাগরে মাছ ধরতেছি। এই সময়ে কতবার যে ঝড়ের কবলে পড়ে ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে এসেছি, তার হিসাব নেই। দুবার ট্রলার ডুবে সাগরে বয়া ধরে ভেসে ছিলাম। অন্য ট্রলার এসে উদ্ধার করেছে। বছরে দুই দফায় ৮৭ দিন সাগরে মাছ ধরা যায় না। বাকি সময়ের বেশির ভাগটা আমাদের সাগরে কাটে। ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে সাগরে টিকে থাকি। নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে মাছ ধরতে হয়। এখন আর ডরভয় নাই।’

আবু বকর সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঝড়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ১৩ আগস্ট পিরোজপুরের পাড়েরহাট মৎস্যবন্দর থেকে তিনিসহ ১৩ জন জেলে ট্রলারে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার জন্য রওনা দেন। ২৪ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে তাঁরা সাগরে পৌঁছান। সঙ্গে নেন সাত দিনের খাবার ও জ্বালানি। ১৮ আগস্ট বেলা তিনটা থেকে এক ঘণ্টা সাগরে ঝোড়ো বাতাস ও বৃষ্টি ছিল। এরপর ঝড় থেমে যায়। ওই দিন রাত ১০টার দিকে আবার শুরু হয় ঝড়। প্রচণ্ড ঢেউয়ে ট্রলারগুলো ভেসে চলে যায় সাগরের নানা দিকে। অনেক ট্রলার ঢুকে পড়ে ভারতের জলসীমার মধ্যে।

কয়েকটি ট্রলার তলা ফেটে ডুবে যায়। পরের দিন বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ঝড় ছিল। ১৯ আগস্ট ইন্দুরকানি উপজেলার ঢেপসাবুনিয়া গ্রামের সাইফুল মাতুব্বরের এফবি ভাই–বোন নামের ট্রলারটির তলা ফেটে ডুবে যায়। ওই ট্রলারের ১৩ জেলে সাগরে ভেসে যান। কবির হোসেন ও জাকারিয়া নামের দুই জেলেকে উদ্ধার করে ভারতীয় একটি ট্রলার সুন্দরবনের কাছে দুবলার চরে পৌঁছে দেয়। সেখান থেকে তাঁদের তুলে নেন তাঁরা।

বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া এফবি ভাই–বোন ট্রলারের জেলে কবির হোসেন (৩৮) বলেন, কাঠের তৈরি ট্রলারগুলো সম্পূর্ণ ডুবে যায় না। ট্রলারের কিছু অংশ ভেসে থাকে। অনেক সময়ে জেলেরা ভেসে থাকা ট্রলার ধরে কিংবা ট্রলারে থাকা বয়া ও ফ্লুট নিয়ে সাগরে ভেসে থাকেন। পরে কোস্টগার্ড বা অন্য ট্রলারের জেলেরা তাঁদের উদ্ধার করেন। আবার কেউ কেউ সাগরে ডুবে মারা যান। এমন হয় যে কয়েক ঘণ্টা বয়া নিয়ে ভাসতে ভাসতে ক্লান্ত হয়েও মারা যান অনেকে।

সমুদ্রগামী জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি ট্রলার ৭ থেকে ১০ দিনের খাবার ও জ্বালানি নিয়ে সাগরে মাছ ধরার জন্য যায়। সাধারণত আকারভেদে ট্রলারে ১১ থেকে ১৭ জন জেলে থাকেন। একটি ট্রলারে ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকার জ্বালানি ও মালামাল থাকে। ট্রলারের দামও অনেক। কোনো ট্রলার সাগরে ডুবে গেলে সেটি উদ্ধার করা যায় না। ফলে ট্রলারের মালিকেরা নিঃস্ব হয়ে যান।

পিরোজপুর জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি কমল দাস বলেন, পিরোজপুরের ২০০ মাছ ধরার ট্রলার সাগরের বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়েছিল। বেশ কিছু ট্রলার ভারতের জলসীমায় ঢুকে পড়েছিল। তিনি সরকারের কাছে দাবি জানান, কোনো ট্রলার ডুবে গেলে সেটি উদ্ধারে সহযোগিতা করার এবং ক্ষতিগ্রস্ত জেলে ও ট্রলারমালিকদের সহায়তা করার।

এ ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মন্ত্রণালয় মূলত মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ও বিপণন নিয়ে কাজ করে। বঙ্গোপসাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের সহায়তা দেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।