২৩ বছরেও বিচার শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ

২০০১ সালের ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় আওয়ামী লীগের কার্যালয় বোমা হামলায় দুই পা হারান তৎকালীন যুবলীগ নেতা রতন দাস
ছবি: প্রথম আলো

নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বোমা হামলার মামলায় বিচারকাজ শেষ হয়নি ২৩ বছরেও। ২০০১ সালের ১৬ জুনের ওই হামলায় ২০ জন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হন। দীর্ঘদিনেও হামলার বিচার না পেয়ে ক্ষুব্ধ নিহত ও আহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা। সাক্ষী হাজির না হওয়ায় মামলাটির বিচারকাজ ঝুলে গেছে। এ হামলায় নিহত ও আহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা মামলার বিচারকাজ দ্রুত শেষ করে দোষী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মনিরুজ্জামান বুলবুল প্রথম আলোকে বলেন, অনেক আগেই মামলাটি নিষ্পত্তি হওয়া উচিত ছিল। মামলাটি বর্তমানে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও নিহত ব্যক্তিদের ময়নাতদন্তের সঙ্গে জড়িত চিকিৎসকেরা সাক্ষ্য দিলে মামলার বিচারকাজ শেষ করতে বেশি সময় লাগবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বোমা হামলার ঘটনায় মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ১১ বছর আগে হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ছয়জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। কিন্তু সাক্ষী না আসায় বিচার শেষ করা যাচ্ছে না। এ মামলায় ১০৩ জনকে সাক্ষী করা হলেও বাদীসহ মাত্র ২২ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী তারিখ ২৬ জুন।

অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হলেন মহানগরের ওই সময়ের স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা শাহাদাৎউল্লাহ, হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, হুজি সদস্য দুই ভাই আনিসুল মোরসালীন ও মাহবুবুল মুত্তাকিন, নগরীর উত্তর চাষাঢ়ার বাসিন্দা ওবায়দুল হক ও বিএনপি নেতা শওকত হাশেম।

মামলার বাদী নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা প্রথম আলোকে বলেন, মামলার নথিতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা এএসপি আমিনুল ইসলামকে হাজির হতে তলব করেছেন আদালত। আগামী বছরের ১৬ জুনের আগে এই মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

তবে এ বিষয়ে জেলা জজ আদালতের পিপি মনিরুজ্জামান বুলবুল বলেন, ‘ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হয়তো তদন্তকারী কোনো কর্মকর্তার কাছে রয়েছে। যদি তাঁদের কাছে না থাকে, তাহলে আমাদের কাছে ফটোকপি আছে, সেটি সিভিল সার্জন অফিস থেকে সত্যায়ন করে এ মামলার কার্যক্রম চালানো যাবে।’

পিপি আরও বলেন, গত বছর সাক্ষীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলেও তাঁরা হাজির হননি। অনেক সাক্ষী মারা গেছেন, অনেক সাক্ষীর ঠিকানা পরিবর্তন হয়েছে এবং অনেকে অবসরে গেছেন। এসব কারণে মামলার বিচারকাজ শেষ করতে বিলম্ব হচ্ছে।

এই বোমা হামলায় দুই পা হারিয়েছেন যুবলীগ নেতা রতন দাস ও তৎকালীন কৃষক লীগ নেতা চন্দন শীল। তাঁদের মধ্যে চন্দন শীল নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি। তিনি বলেন, সব বোমা হামলা একই সূত্রে গাঁথা। দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে অসহায় পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য রাষ্ট্রের প্রতি আহবান জানান তিনি।

ওই দিনের বোমা হামলায় নিহত হন শহরের উত্তর চাষাঢ়া এলাকার নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজের সাবেক জিএস আক্তার হোসেন ও তাঁর ছোট ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক মোশারফ হোসেন। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেক পরিবার ভীষণ অর্থকষ্টে জীবন যাপন করছে।

নিহত আক্তার হোসেনের স্ত্রী সোহানা আক্তার বলেন, দেশে অনেক হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। কিন্তু এই বোমা হামলার বিচার ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানান তিনি।

২০০১ সালের ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বোমা হামলায় নিহত হন সরকারি তোলারাম কলেজের সাবেক জিএস আক্তার হোসেন। আক্তার হোসনের কথা মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর স্ত্রী সোহানা আক্তার
ছবি: প্রথম আলো

সেদিনের কথা মনে করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী হামিদা ইসলাম। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘কীভাবে বেঁচে আছি, তা বলে বোঝাতে পারব না। নিহতদের পরিবারগুলো কীভাবে চলছে, সরকারের তা দেখা উচিত।’

২০০১ সালের ১৬ জুন রাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে পূর্বনির্ধারিত গণসংযোগ কর্মসূচিতে বোমা হামলায় ২০ জন নিহত হন। বোমা হামলায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন সাইদুল হাসান, আক্তার হোসেন, মোশারফ হোসেন, নজরুল ইসলাম, দেলোয়ার হোসেন ভাষানী, সাইদুর রহমান মোল্লা, নজরুল ইসলাম, স্বপন চন্দ্র দাস, শওকত হোসেন, স্বপন দাস, এনায়েত উল্লাহ, পলি বেগম, হালিমা বেগম, আবদুল আলীম, শুক্কুর আলী, নিধুরাম বিশ্বাস, রাজিয়া বেগম, আবদুস সাত্তার, আবু হানিফ নবী ও অজ্ঞাতপরিচয় এক নারী। আহত হন শতাধিক ব্যক্তি।

ওই ঘটনায় মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় দুটি মামলা করেন। এক যুগ পর ২০১৩ সালের ২ মে মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে পৃথক দুটি অভিযোগপত্র দাখিল করে।

সিআইডির অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হলেন মহানগরের ওই সময়ের স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা শাহাদাৎউল্লাহ, হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, হুজি সদস্য দুই ভাই আনিসুল মোরসালীন ও মাহবুবুল মুত্তাকিন, নগরীর উত্তর চাষাঢ়ার বাসিন্দা ওবায়দুল হক ও বিএনপি নেতা শওকত হাশেম।

তাঁদের মধ্যে সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। বর্তমানে শাহাদাৎউল্লাহ কারাগারে আছেন। দিল্লিতে জঙ্গি হামলার অভিযোগে দুই ভাই আনিসুল মোরসালীন ও মাহবুবুল মুত্তাকিন ভারতের কারাগারে আটক। ওবায়দুল হক দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। আর শওকত হাশেম উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন। বর্তমানে তিনি নারায়ণগঞ্জ সিটির ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।