‘বিরোধপূর্ণ’ জমি থেকে একটি মেহগনিগাছ কাটা নিয়ে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। একপর্যায়ে এই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন একই গ্রামের দুটি পক্ষ, যা পরে সংঘাতে রূপ নেয়। এই বিরোধের জেরে একপর্যায়ে খুন হন দুই চাচাতো ভাই। ওই ঘটনায় মামলাও হয়। তবু গ্রামটিতে শান্তি ফেরেনি। ঘটনার প্রায় চার মাস পার হলেও প্রতিপক্ষের হামলা ও সহিংসতার ভয়ে অন্তত ৪১ পরিবারের দেড় শতাধিক মানুষ এখনো বাড়িছাড়া বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ১০ এপ্রিল দুপুরে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার চন্দননগর ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে ওই দুজন খুন হন। তাঁরা হলেন, শরিফুল ইসলাম (৪০) ও তাঁর চাচাতো ভাই আইজুল ইসলাম (৩৫)।
মামলার একাধিক আসামি ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পর বদলা নিতে বাদীপক্ষের লোকজন আসামিদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালান। এতে কয়েকটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাঁদের নিজ বসতভিটায় ফেরার অবস্থা নেই। ফলে বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আশপাশের গ্রামের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলে গিয়ে দুই পক্ষে শান্তি ফেরানোর চেষ্টা করছেন। তবে এতে কোনো লাভ হয়নি।
পুলিশ ও কয়েকজন এলাকাবাসীর সূত্রে জানা গেছে, বসতভিটার জমি নিয়ে ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের রেজাউল ইসলাম, তাঁর ভাতিজা শরিফুল ইসলাম ও ময়নুল হকের সঙ্গে একই গ্রামের কাশেম হাজী ও তাঁর ছোট ভাই লাল চানের বিরোধ চলছিল। সেই জমিতে বেশ কয়েকটি মেহগনিগাছ লাগানো আছে। গত ৯ এপ্রিল সেখান থেকে একটি মেহগনিগাছ কাটেন শরিফুল। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। এর জেরে পর দিন (১০ এপ্রিল) কাশেম হাজী ও লাল চানের নেতৃত্বে তাঁদের পক্ষের লোকজন দেশি অস্ত্র ও লাঠি নিয়ে প্রতিপক্ষ শরিফুলের ওপর হামলা চালান। এতে ঘটনাস্থলেই শরিফুলের মৃত্যু হয়। এ সময় আবার উভয় পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে শরিফুলের চাচাতো ভাই আইজুল, চাচা রেজাউল, শরিফুলের ছোট ভাই ময়নুলসহ অন্তত আটজন আহত হন। পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আইজুলের মৃত্যু হয়।
ওই ঘটনায় নিহত শরিফুলের স্ত্রী শাহনাজ বেগম বাদী হয়ে লাল চান, কাশেম হাজী ও উপজেলা বিএনপির স্বেচ্ছাসেবাবিষয়ক সম্পাদক শহিদুল ইসলামসহ ৬১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১০-১৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ২৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে নিয়ামতপুর থানা-পুলিশ। এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে শহিদুলসহ অনেকেই জামিনে আছেন।
গত শনিবার মামলার আসামি কাশেম হাজী ও তাঁর ভাই লাল চানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির দরজা-জানালা ভাঙা, মোটরসাইকেল, ফ্রিজসহ বিভিন্ন আসবাবপত্রের ভাঙা অংশ এখানে-সেখানে পড়ে আছে। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ব্যবহার্য জিনিসপত্র। একই চিত্র আসামি শফিকুলসহ আরও ১০-১২টি বাড়িতে।
কাশেম ও লাল চানের বাবা কছিমুদ্দিন জানান, কার আঘাতে কীভাবে খুন হয়েছে, জানা নেই। তবে তাঁর দুই ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পুলিশের তদন্ত ও আইন-আদালতের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে। কিন্তু তিনি, তাঁর পুত্রবধূ ও নাতি-নাতনিরা মারামারির আশপাশে যাননি। তাঁরা মামলার আসামিও নন। এরপর তাঁদের ওপর হামলা ও বাড়িঘরে ভাঙচুর চালিয়েছে করেছেন বাদীপক্ষের লোকজন। ঘরের সব মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে। এমনকি খেতের ফসল পর্যন্ত কাটতে পারেননি। চার মাস ধরে তাঁরা কেউই বাড়িতে ফিরতে পারছেন না।
গ্রামবাসীরা জানান, গ্রামের অন্তত ৪১টি পরিবারের একই দশা। বাদীপক্ষের লোকজনের হামলা ও সহিংসতার ভয়ে অন্তত ১৫০ লোক নিজেদের ঘরে ফিরতে পারছেন না। তাঁরা দিনের পর দিন মানবেতর জীবন যাপন করছে। তোতা নামের আরেক আসামির স্ত্রী আলতাফনূর বলেন, দুই সান্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আছেন। বাড়ি ফিরতে না পারায় তারা স্কুলে যেতে পারছে না। এভাবে আর কত দিন?
আসামি আজগরের স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন, ‘ওরা যখন বাড়িতে হামলা করতে আসে, তখন আমি প্রাণভয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হই। এরপর আমি কয়েকবার বাড়িতে ঢুকতে চাইলে তাঁরা আমাদের বাধা দিচ্ছে। কেবল বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাট করেও তাঁরা ক্ষান্ত হয়নি। ৪১ পরিবারের প্রায় ২৫০ বিঘা জমির বোরো ধান কেটে নিয়েছে বাদীপক্ষের লোকজন। জমিতে আমন ধান রোপণ করতে পারেনি অনেকে।’
জানতে চাইলে মামলার বাদী শাহনাজ বেগম বলেন, ‘মাত্র একটা মেহগনি গাছ কাটার জন্য ওরা হামার স্বামী ও তার চাচাতো ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করিছে। যাঁরা হত্যা করিছে তাগো যেন ফাঁসি হয়। আসামিরা গ্রেপ্তারের ভয়ে বউ-ছাওয়াল লিয়ে প্যালে গেছে। হামাগের লোকজন কাউকে বাড়িত থেকে বের করে দেয়নি। ওদের বাড়িঘরের মালামাল আত্মীয়স্বজন নিয়ে গেছে। হামাগের কোনো লোকজন লুটপাট করেনি।’
আসামিদের পরিবারের সুস্থ, স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের বাড়িতে বসবাস করার অধিকার আছে বলে জানান নিয়ামতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা অবশ্যই অপরাধী এবং তাঁদের শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু আসামিদের পরিবারের লোকজনকে বাড়িতে ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না—বলে এ পর্যন্ত ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে এ ধরনের খবর পাওয়ার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে নিয়ে ওই গ্রামে গিয়ে জানতে পেরেছি, আসামিপক্ষের ১৬-১৭টি পরিবার ইতিমধ্যে নিজেদের বাড়িতে ফিরেছেন। বাকিরা যেন নির্ভয়ে বাড়িতে ফেরেন—এমন আহ্বান জানানো হয়েছে।’