সন্তানদের পড়িয়ে সুদিন আনার আশায় বনে যান শিখা

একটু একটু করে পশ্চিম আকাশের বুকে হেলে পড়ছে সূর্য। আবিররঙা হয়ে উঠেছে আকাশ ও চারপাশ। বিকেলের এই সময়ে শাকবাড়িয়া নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ওপারের সুন্দরবনের চরে প্রায়ই হরিণের চলাচল দেখা যায়। সম্প্রতি নদীর চরে হরিণের বিচরণ দেখব বলে খুলনার কয়রা উপজেলার নয়ানী গ্রামের শাকবাড়িয়া নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। গ্রামটির ওপারে সুন্দরবন, এপারে লোকালয়। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে শাকবাড়িয়া নদী। পশ্চিম আকাশ থেকে সূর্যের আলো উঁচু গাছের মাথায় আটকে শাকবাড়িয়া নদীতে গাছের ছায়া পড়েছে। নদীতে তখন শুরু হয়েছে ভাটার টান।

বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে হরিণের বিচরণ না দেখলেও দেখতে পাই সুন্দরবনের ভেতর থেকে একটি ছোট ডিঙিনৌকা বেয়ে ফিরছেন এক নারী। পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে ছবি তুলতে শুরু করি। ডিঙির মাথায় বসে বইঠার ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ তুলে ফিরে আসেন লোকালয়ের পাড়ে। এবার বইঠা রেখে নৌকার ভেতর থেকে ছোট ত্রিভুজ আকৃতির বিশেষ এক জাল বের করে নদীতে পা ঝুলিয়ে মাথা ঝুঁকে নদীর মধ্যে কয়েকবার জালের টানা দিলেন। মাথা তুলে নদীর পাড়ে মুঠোফোন হাতে আমাকে দেখে হেসে বললেন, ‘দাদা, ছবি তুলছেন?’ ‘হ্যাঁ’সূচক জবাবে খুশি হয়ে বললেন, ‘গরিব মাইনসের ছবি কেউ তুলতে চায় না। সবাই খালি নেতাগোতাগের ছবি তোলে।’
আলাপে আলাপে জানা গেল, তাঁর নাম শিখা মণ্ডল। পাশের নয়ানী গ্রামেই তাঁর বাড়ি।

পরিবারে সুদিনের আশায় দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে নিয়মিত সুন্দরবনে যান তিনি। বন তাঁর কাছে বাড়ির উঠানের মতো। সকাল থেকে বিকেল কেটে যায় সেখানে। সকালের খাবার খেয়ে ডিঙিনৌকা চালিয়ে সুন্দরবনে গিয়েছিলেন। সারা দিন বনের মধ্যে ছোট ছোট খালে জাল টেনে চিংড়ির রেণু পোনা ধরেছেন। সন্ধ্যার আগে বাড়িতে ফেরার সময় বাড়তি আয়ের আশায় লোকালয়ের নদীতেও ছোট জাল দিয়ে বাগদার রেণু ধরার চেষ্টা করছেন। দিনে আয় হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। ছেলে কঙ্কণ মণ্ডল একাদশ ও মেয়ে তিথি পড়ছে দ্বাদশ শ্রেণিতে। স্বামী পরীক্ষিত মণ্ডলও আলাদাভাবে বনে যান। দুজনের বনে মাছ ধরার আয় দিয়ে প্রতি মাসের খরচ জোগানো কঠিন হয়ে পড়ে। তখন ধারদেনাও করতে হয়।

শিখা মণ্ডল বলছিলেন, টাকার অভাবে এসএসসি পাস বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। স্বামীর একার আয়ে সংসারে টানাটানি লেগে থাকে। এ কারণে লেখাপড়ার খরচ জোগানো সম্ভব হচ্ছিল না। বড় মেয়ের পড়াশোনা শেষ করাতে পারেননি, ছোট দুই সন্তানেরও যাতে বন্ধ না হয়; সে জন্য রোজগারের দায়িত্ব নিজেও কিছুটা নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যত কষ্টই হোক, সন্তানগের শেষ অবধি পড়াব। তারা ভালো পরিবেশে ভালো জীবন যেন পায়।’

শিখা মণ্ডল তাঁর হাত ও শরীরের কালচে দাগ দেখিয়ে বলেন, ‘সুন্দরবনের মধ্যে পোকার কামড়ে এমন হয়েছে। সারা দিন লোনাপানিতে থাকায় হাত-পায়ে ছোপ ছোপ কালো দাগ পড়েছে।’ জঙ্গলে একা যেতে ভয় লাগে না?—এমন প্রশ্ন শুনে শিখা মণ্ডলের সহজ জবাব, ‘মনে ভয় লাগলে পেটে তো শোনে না। আমার কাছে ভয় তাড়ানোর মাদুলি আছে।’

এলাকার বেশির ভাগ মানুষ বনজীবী জানিয়ে নয়ানী গ্রামের বনরানী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আতিয়ার রহমান বলেন, গ্রামের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যেতে চায় না। যে বয়সে ওদের স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই শিশুকাল থেকেই ওরা শুরু করে বনের কাজে যাওয়ার কৌশল সম্পর্কে। শিখা মণ্ডলের পরিবার সে ধারা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। হয়তো পরিবারটি গোটা গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়াবে।