ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ঘেঁষে উঠছে বহুতল ভবন

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। গত বুধবার নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নে
ছবি: প্রথম আলো

আইন অমান্য করে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের দেয়াল ঘেঁষে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। বিহারের সত্যপীরের ভিটা-সংলগ্ন মালঞ্চা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একতলা ভবনের ওপর আরেক তলা উঠছে। এ অবস্থায় বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে পাহাড়পুরের নাম বাদ পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সংরক্ষিত পুরাকীর্তির কাছে বহুতল ভবন নির্মাণ বাংলাদেশ সরকারের ১৯৬৮ সালের (১৯৭৬ সালে সংশোধিত) পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনের পরিপন্থী। এ ছাড়া বিশ্ব ঐতিহ্যের কেন্দ্র থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে বহুতল ভবন নির্মাণ ইউনেসকো বিধিবিধানপরিপন্থী।

বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণকাজ বন্ধেপ্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নওগাঁর জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসানকে চিঠি দিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক চন্দন কুমার দে।

অথচ পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইন অমান্য করে এক সপ্তাহ ধরে বৌদ্ধবিহারের কাছে বহুতল ভবন নির্মাণকাজ চলছে। অবশ্য স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, কাজ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালে বিদ্যালয়টির ভবন ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়েছিল। তখন বৌদ্ধবিহার জাদুঘরের তৎকালীন কাস্টোডিয়ান নির্মাণকাজ বন্ধে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠালে কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ করে ওই ভবনের নির্মাণকাজ পুনরায় শুরু করা হয়।

গত বুধবার সকালে মালঞ্চা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, স্কুলটি পাহাড়পুর জাদুঘর থেকে ২০০ গজ, বিহারের মূল মন্দির থেকে ৪০০ গজ পূর্বে অবস্থিত। দ্বিতল ভবনের জন্য আরসিসি পিলার ইতিমধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। পিলারের ওপর বিমের জন্য কাঠ দিয়ে শাটারিংয়ের কাজ করছিলেন কয়েকজন নির্মাণশ্রমিক। শাটারিংয়ের বেশির ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। দুজন শ্রমিক বলেন, ‘আমরা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে কাজ করছি। আমাদের দ্রুত শাটারিংয়ের কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে।’

এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে চিঠি দিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক চন্দন কুমার দে। নওগাঁর জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘ইতিমধ্যে ওই বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছি।’

বৌদ্ধবিহার জাদুঘরের কাস্টোডিয়ানের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে সত্যপীরের ভিটা-সংলগ্ন মালঞ্চা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয়। নির্মাণকাজ বন্ধে তৎকালীন কাস্টোডিয়ান মো. আবু সাঈদ ইনাম তানভিরুল সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিলে নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু হঠাৎ করে চলতি বছর আবার কাজ শুরু করা হলে ১৯ জানুয়ারি বর্তমান কাস্টোডিয়ান মোহাম্মদ ফজলুল করিম উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে একটি চিঠি দেন। চিঠির অনুলিপি বিভিন্ন দপ্তরে পাঠান তিনি। এরপর গত ২৯ জানুয়ারি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জেলা প্রশাসককে চিঠি দেন। চিঠির অনুলিপি নওগাঁর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও পাহাড়পুর জাদুঘরের কাস্টোডিয়ানের কাছে পাঠানো হয়।

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার
ফাইল ছবি

কাস্টোডিয়ান মুহাম্মদ ফজলুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত প্রত্নস্থল। এর এক কিলোমিটারের মধ্যে বহুতল ভবন নির্মাণ ইউনেসকোর বিধিবিধানপরিপন্থী। বৌদ্ধবিহার এলাকায় এমন স্থাপনার কারণে ইউনেসকোর তালিকা থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি বদলগাছি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলপনা ইয়াসমীনকে জানানো হয়েছে।

ইউএনও আলপনা ইয়াসমীন বলেন, ওই বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবন নির্মিত হলে বৌদ্ধবিহারের নাম ইউনেসকোর তালিকা থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কার কথা কাস্টোডিয়ান তাঁকে জানিয়েছেন। উপজেলা প্রকৌশলীকে কাজটি বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।

উপজেলা প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, পাহাড়পুরে বহুতল রেস্টহাউস ও কোয়ার্টার আছে। এক কিলোমিটারের মধ্যে পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে। সেটিও বহুতল ভবন। স্থানীয় সংসদ সদস্য ছলিমউদ্দিনকে জানিয়ে ওই বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবনের কাজ শুরু করা হয়েছিল। তবে কাজটি আবার বন্ধ করা হয়েছে।

নওগাঁ-৩ (বদলগাছী-মহাদেবপুর) আসনের সংসদ সদস্য ছলিমউদ্দিন তরফদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে উপজেলা প্রকৌশলী জানিয়েছিলেন, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের কাছে বহুতল ভবন আছে। আমি তাঁকে পুরাকীর্তি আইন মেনে কাজ করার কথা বলেছি।’

বৌদ্ধবিহারের এক কিলোমিটারের মধ্যে বহুতল স্থাপনার বিষয়ে কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে এমনিতেই ইউনেসকোর হুমকির মধ্যে আছি। পুলিশ ফাঁড়ি বিহার থেকে অনেক আড়ালে। আমরা রেস্টহাউস ও কোয়ার্টারগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। নতুন করে বৌদ্ধবিহার ঝুঁকিতে পড়ুক, সেটা আমরা চাই না।’