তলানিতে ব্রহ্মপুত্রের পানি, পাড়ে খননের বালুর স্তূপ

খননের পরও ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদের বিভিন্ন এলাকায় চর জাগছে। নগরের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ঘেঁষা গ্রাম ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার খোদাবক্সপুর ভাটিপাড়া। এই গ্রাম থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পাড়ে তাকালে দেখা যায় বিশাল বালুর স্তূপ। বালুর স্তূপের কারণে ওই পাড়ের জনবসতি চোখে পড়ে না।

গ্রামের একাধিক ব্যক্তি বলেন, খননের আগে ওই পাড়ের বাড়িগুলো দেখা যেত। বর্ষায় পানি বাড়লে বিস্তৃত নদ চোখে পড়ত। তবে ২০২১ সালে ব্রহ্মপুত্র নদ খননের পর তোলা বালু নদের মধ্যেই বিশালাকার স্তূপ করে রাখার কারণে এখন আর ওই পাড় চোখে পড়ে না। নদ বলতে এখন ভাটিপাড়া গ্রামের মানুষ নিজেদের চোখে দেখা যাওয়া অর্ধেক অংশকেই চিনে।

বিভিন্ন সময়ে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের কারণে খোদাবক্সপুর ভাটিপাড়া গ্রামের শত শত পরিবার উচ্ছেদ হয়েছে। মাঝখানে কয়েক বছর ভাঙন থেমে থাকলেও খননের বালুর স্তূপ নদের মাঝখানে রাখার কারণে বর্ষাকালে পানির চাপে ভাঙন দেখা দেয়।

নদের পাড়ের বাসিন্দা এরশাদ মিয়া বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই ব্রহ্মপুত্র দেখে বড় হয়েছি। সে অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি, খননের বালু নদের পাড়ে বিশাল স্তূপ করে রাখার কারণে বর্ষায় স্রোতের ধারা নিজের মতো প্রবাহিত হতে পারে না। যে কারণে দুই বছর ধরে আবারও ভাটিপাড়ার কিছু বাড়িঘর ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে।’

শুধু ভাটিপাড়া গ্রামে নয়, ব্রহ্মপুত্র নদ খননের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় নদের পাড়ে খননের বালু রাখা হচ্ছে। ওই সব বালু নিলামের বিক্রি করা হলেও বিক্রির আগে কয়েক বছর পড়ে থাকে। যেসব বালুর স্তূপ থেকে বালু পরিবহন কঠিন, সেসব বালুর স্তূপ অবিক্রীত থাকে। আবার অবিক্রীত বালু রাতের অন্ধকারে লুট করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও আছে।

খননের বালু বিক্রির দায়িত্ব পালন করেছে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। গত রোববার ময়মনসিংহের ডেপুটি কালেক্টর (রাজস্ব) দিলরুবা ইসলামের কার্যালয় থেকে জানা যায়, ময়মনসিংহ জেলায় এ পর্যন্ত খননের ফলে উত্তোলিত ৭ কোটি ৫৪ লাখ ২৫ হাজার ঘনফুট বালু নিলামে বিক্রি করা হয়েছে। অনেক অবিক্রীত বালুর স্তূপের এখনো পরিমাপ করা হয়নি।

ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ঘেঁষা ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার গ্রাম মরিচার চর নামাপাড়া। ব্রহ্মপুত্র নদ খননকাজের প্রভাবে ওই গ্রামে গত তিন বছর ধরে দেখা দিয়েছে ভাঙন। ভাঙনের কারণে ৫০টি বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। একটি সড়কের ৮০ ভাগ বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামের একাধিক বাসিন্দা বলেন, ২০২১ সালে প্রথম ওই এলাকায় খনন কাজ শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ। ওই সময় অপরিকল্পিতভাবে বালুর স্তূপ দেওয়ার কারণে নদীভাঙন শুরু হয়। পাশাপাশি বালুর স্তূপের কারণে নদের একটি ছোট ধারা সৃষ্টি হয়ে কয়েক শ একর ফসলের জমি নষ্ট হয়েছে।

রাতের আঁধারে ওই এলাকায় নৌকায় করে দুর্বৃত্তরা ড্রেজারের মাধ্যমে বালু তুলে নিচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। মরিচার চরনামা গ্রামের বাসিন্দা আস্কর আলী বলেন, অবৈধ বালু তোলা বন্ধ করতে গ্রামবাসী একাধিকবার মানববন্ধন করেছেন। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। তাতেও বন্ধ হয়নি বালু তোলা।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নদ খননের কাজ শুরু করে ২০১৯ সালের জুন মাসে। চলতি বছরের জুনে এ কাজ সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল। তবে খননের সুফল না পাওয়ায় এ কাজের মেয়াদ বেড়েছে এক বছর। ২০২৫ সালের জুন মাসে শেষ হবে ব্রহ্মপুত্র নদ খননের এ প্রকল্পের কাজ। সাড়ে চার বছরে এ প্রকল্পের সুফল না পাওয়া এবং খননকাজের পরিকল্পনার অভাব রয়েছে বলে নাগরিক সমাজ, নাগরিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অভিযোগ শেষ নেই। তাদের অভিযোগ, ব্রহ্মপুত্র নদ খননের নামে মূলত ব্রহ্মপুত্রকে খালে পরিণত করা হচ্ছে। নদের প্রস্থে মাত্র ১০০ মিটার এবং ৬ থেকে ১০ ফুট গভীরতায় এ খননকাজ চলছে।

ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলন নামের নাগরিক সংগঠনের সমন্বয়ক আবুল কালাম আল আজাদ বলেন, এ খননের নামে ব্রহ্মপুত্রকে খালে পরিণত করা হচ্ছে। খননের মাটি পাড়ে রাখায় বাড়ছে অবৈধ দখল। ইজারার নামে অবৈধ বালু তোলায় বাড়ছে ভাঙন। সাড়ে চার বছরে যে খননের সুফল পাওয়া যায়নি, প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হলেও তেমন কিছু হবে বলে মনে হয় না। এসব লোক দেখানো কাজ। ব্রহ্মপুত্র নদের নানা অসংগতি নিয়ে বহুবার সভা-সেমিনারে কথা বললেও কর্তৃপক্ষ কখনোই কর্ণপাত করেনি।

ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদ খননের বালু রাখা হচ্ছে নদের পাড়ে। নগরের জেলখানার ঘাট এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি সরেজমিনে ময়মনসিংহ নগরের পাটগুদাম ব্রিজ, কাচারিঘাট, জয়নুল আবেদিন পার্ক, জেলাখানার ঘাট ও পুলিশ লাইনস এলাকায় দেখা যায়, ওই সব এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি খুব কম। বিভিন্ন এলাকায় চর জেগেছে। গৌরীপুর ও ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের গ্রামগুলোতে দেখা যায়, কোথাও বেশি থাকলেও তার পাশেই আবার ছোট ছোট চর। অথচ ওই সব এলাকায় আগে খননকাজ করা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, ২০২০ সালে ওই সব এলাকায় এক দফা খননকাজ করা হয়েছে। তবে ২০২১ সালের নভেম্বর মাস থেকে ছোট ছোট চর জাগে। চর জাগায় খননকাজের সুফল পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে ময়মনসিংহের একটি নাট্য সংগঠন জেগে ওঠা চরে নাটক মঞ্চস্থ করে প্রতিবাদ জানায়। গত বছরের মে মাসে ময়মনসিংহের তরুণেরা খনন হওয়া ব্রহ্মপুত্র নদের হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে ‘মৃতের চিৎকার’ শিরোনামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে প্রতিবাদ জানান।

ব্রহ্মপুত্র নদ খননকাজ শুরু পর ময়মনসিংহে এ প্রকল্পের একটি অফিস হওয়ার কথা থাকলেও সাড়ে চার বছর পরও তা হয়নি। খনন প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার একমাত্র মাধ্যম মুঠোফোন।

সম্প্রতি মুঠোফোনে কথা হয় ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র খননের দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মহসিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, উৎসমুখে খনন না হওয়ায় এখনো সুফল মিলছে না। গাইবন্ধা জেলার ফুলছড়ি ইউনিয়নে যমুনার সঙ্গে মিলেছে ব্রহ্মপুত্র। সেখানে খনন না হওয়ায় সুফল মিলছে না। ওই এলাকায় বিস্তৃত অংশ শুকনা। সেখানে খননকাজ করতে গেলে স্থানীয় মানুষ বাধা দেয়। বিষয়টি নিয়ে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা হয়েছে। ময়মনসিংহে খনন প্রকল্পের কার্যালয় বিষয়ে তিনি বলেন, জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে কার্যালয় করা হবে। সে প্রক্রিয়া চলছে।

বালুর বিষয়ে মোহাম্মদ মহসিন বলেন, এটি ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় দেখছে।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আলমগীর কবীর বলেন, নিলামের মাধ্যমে বালু বিক্রি হচ্ছে। অনেক বালু বিক্রি হয়েছে। আবার নতুন করে তোলা কিছু বালু রয়ে গেছে। এগুলো যথা নিয়মে বিক্রি করা হবে।

ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদ খনন প্রকল্পের সূত্রে জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ময়মনসিংহ, জামালপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলার মোট ২২৭ কিলোমিটার অংশ খনন করা হচ্ছে।