মধুখালীতে দুই শ্রমিককে হত্যা, দুই মাস পরও সেই চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার হননি

ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান
ছবি: সংগৃহীত

ফরিদপুরের মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লির একটি মন্দিরের প্রতিমায় আগুন দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই নির্মাণশ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার দুই মাস পর অভিযুক্ত ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান ও সদস্য অজিত বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এই ঘটনার পর পঞ্চপল্লির জনজীবন স্বাভাবিক হয়নি, কাটেনি আতঙ্ক।

গতকাল মঙ্গলবার মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লি এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে ও নিহত দুই নির্মাণশ্রমিকের বাড়ি নওপাড়া ইউনিয়নের চোপেরঘাট গ্রামে গিয়ে তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

ই নির্মাণশ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ডুমাইন ইউপির চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামানকে গত ২০ মে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। দুই মাস পরও অভিযুক্ত ওই চেয়ারম্যান ও ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য অজিত কুমার বিশ্বাস গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহত আশরাফুল ও আসাদুলের স্বজনেরা।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পঞ্চপল্লি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে পঞ্চপল্লি সর্বজনীন কালীমন্দির । গত ১৮ এপ্রিল এ মন্দিরের প্রতিমার শাড়িতে আগুন লাগে। প্রতিমার শাড়িতে আগুন দেওয়ার অভিযোগ তুলে পাশের বিদ্যালয়ে একটি ওয়াশ ব্লক নির্মাণকাজে নিয়োজিত নির্মাণশ্রমিকদের দড়ি দিয়ে বেঁধে বিদ্যালয়ের ঘরের একটি কক্ষে আটকে রেখে মারধর করা হয়। পরে এই ঘটনার ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, ইউপি চেয়ারম্যান এ মারধরে অংশ নিয়েছেন। এ ঘটনায় চারজন নির্মাণশ্রমিক আহত হন। পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুই সহোদর আশরাফুল খান (২০) ও আসাদুল খান (১৭) মারা যান।  হত্যার ঘটনার তিনটি ভিডিও ক্লিপ গত ২৩ এপ্রিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ইউপি চেয়ারম্যান আত্মগোপনে চলে যান।

দুই নির্মাণশ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ডুমাইন ইউপির চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামানকে গত ২০ মে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। দুই মাস পরও অভিযুক্ত ওই চেয়ারম্যান ও ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য অজিত কুমার বিশ্বাস গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আশরাফুল ও আসাদুলের স্বজনেরা।

পঞ্চপল্লি থেকে দুপুর ১২টার দিকে নওপাড়া ইউনিয়নের চোপেরঘাট গ্রামে গিয়ে কথা হয় আশরাফুল ও আসাদুলের বাবা শাহজাহান খানের (৪৭) সঙ্গে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বিদেশে যাইয়া নেতা মারা যায়। তার খুনিরা শনাক্ত হয়, ধরা পড়ে; কিন্তু আমার দুই ছেলের খুনিরা ধরা পড়ে না। দুইডা মাস চইলা গেল, চেয়ারম্যান-মেম্বার ধরা পড়ে নাই।’

ঘটনার দুই মাস পরও ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেন, তাঁদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ডুমাইন ইউপি চেয়ারম্যান শাহ্ আসাদুজ্জামানকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার পাশাপাশি কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়। ওই চেয়ারম্যানের নামে মেইলে কারণ দর্শানো নোটিশের একটি জবাব এসেছে। এটি তাঁর কি না, সেটি যাচাই করে স্থায়ী বরখাস্তের সুপারিশসহ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, স্থায়ীভাবে বহিষ্কৃত হলে ওই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে নতুন করে নির্বাচন আয়োজন করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সুপারিশ করা হবে।

সকাল ১০টার দিকে পঞ্চপল্লির বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মন্দিরের প্রতিমার পুড়ে যাওয়া শাড়ির বদলে নতুন এটি শাড়ি পরানো হয়েছে। এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ওই মন্দিরের পূজারি তপতী মণ্ডল গত ৮ মে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আগের দিন ওই প্রতিমায় নতুন শাড়ি পরিয়ে দিয়েছেন।

ফরিদপুরের মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নে দুই নির্মাণশ্রমিককে হত্যার ঘটনার পর তিনটি মামলা হয়। এরপর থেকেই পঞ্চপল্লির মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়নি। গতকাল ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

পঞ্চপল্লি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উত্তর দিকে সঞ্জয় ও সঞ্জীবন মণ্ডলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কোনো ঘরে কোনো লোক নেই। চারদিকে সুনসান নীরবতা। একটি কবুতরের খোপ রয়েছে, যার সব কটি দরজা খোলা।

পঞ্চপল্লির কৃষ্ণনগর গ্রামের কাঠমিস্ত্রি কার্তিক মণ্ডলের স্ত্রী অঞ্জনা মণ্ডল বলেন, ‘ভয়ে ব্যাটারা (পুরুষেরা) বাড়িতে এখনো আসে নাই। সংসার আর চলে না। কারও কাছ থেকে আটা কারও কাছ থেকে চাল আলু আইনা কোনোমতে খাইয়া বাঁইচা আছি।’

কৃষ্ণনগর গ্রামের জনেক মণ্ডলের স্ত্রী সুমিত্রা মণ্ডল (৩৫) বলেন, ওই ঘটনার আগে জমিতে পাট রোপণ করা হয়েছিল। গ্রামের সব জমি পড়ে আছে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়িতে পুরুষেরা নেই। তাই পাটখেতে নিড়ানি দেওয়া কিংবা সেচ দেওয়া হয়নি। যাঁর ঘরে পেঁয়াজ আছে, তিনি হাটে পেঁয়াজ বিক্রি করে বেঁচে আছেন। কাউকে কাউকে বাবার বাড়ি থেকে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।

কৃষ্ণনগর গ্রামের কয়েকজন গৃহবধূ বলেন, ‘পুলিশ বলেছে দোষীদের ধরবে, যার দোষ নেই, তাদের ধরবে না। কিন্তু কে দোষী আর কে দোষী নয়, তা জানতে না পারায় পুরুষ মানুষ এলাকায় আসছে না। কারা আসামি আর কারা আসামি নয়, এ নামগুলো যদি জানিয়ে দিত, তাহলে আমাদের বাড়ির পুরুষ মানুষদের ফিরতে সুবিধা হতো।’

মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিরাজ হোসেন বলেন, ১৮ এপ্রিল রাতে পঞ্চপল্লিতে দুই নির্মাণশ্রমিককে হত্যা, পুলিশের ওপর হামলা ও মন্দিরের প্রতিমায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশের ওপর হামলার মামলায় ৩২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া ৮ জনকে হত্যা মামলাও গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ইতিমধ্যে পুলিশের ওপর হামলার মামলায় ৪ জন এবং হত্যা মামলায় ৭ জন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।