সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের আহাজারি থামছে না

সড়ক দুর্ঘটনা
প্রতীকী ছবি

জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত পাঁচজনের পরিবার ও স্বজনদের আহাজারি থামছে না। এই দুর্ঘটনায় কারও মা, কারও বাবা ও কারও ছেলে চিরতরে চলে গেছেন পরপারে। তাঁদের জীবনের গল্প আলাদা। তবে তাঁদের হারিয়ে স্বজনদের সবার দুঃসহ বেদনা–কষ্টের অনুভূতি একই ধরনের। তাঁদের এভাবে চলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না স্বজনেরা।

জয়পুরহাটের ক্ষেতলালের মালিপাড়ায় গতকাল সোমবার ট্রাক-অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। তাঁরা হলেন ক্ষেতলালের শাখারুঞ্জ এলাকার রফিকুল ইসলামের ছেলে নাফিজ ইসলাম (২১), ইটাখোলা এলাকার রইচ উদ্দিনের স্ত্রী শাহনাজ পারভীন (৪৫), নাসিরপুর পূর্বপাড়া জামে মসজিদের ইমাম সিরাজুল ইসলাম (৬০), জয়পুরহাট শহরের বুলুপাড়া এলাকার ফেরদৌসের স্ত্রী শাহিনুর বেগম (৩৮) ও অটোরিকশার চালক ইটাখোলা এলাকার আমজাদ হোসেন (৫৫)। গতকাল ও আজ সকালে তাঁদের নিজ নিজ এলাকার কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় এই ঘটনায় থানায় মামলা করার পর ট্রাকের চালককে আটক করেছে র‍্যাব। আজ মঙ্গলবার বিকেলে র‍্যাবের পক্ষ থেকে প্রেস বিফ্রিংয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানোর কথা রয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে জয়পুরহাট র‍্যাব ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর মো. মোস্তফা জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ট্রাকচালককে আটক করেছি। চালককের সহকারীকে আটকের চেষ্টা চলছে।’

জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শাহনাজ আখতারের বাসায় স্বজনদের ভিড়। আজ মঙ্গলবার সকালে ক্ষেতলালের ইটাখোলা সড়কে
ছবি: প্রথম আলো

ক্ষেতলালের ইটাখোলা সড়কের সরকারি খাদ্যগুদামের পাশে একটি সুন্দর তিনতলা বাড়ি বুলবুল খন্দকারের। তাঁর স্ত্রী নারী উদ্যোক্তা শাহনাজ আখতার গতকালের দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। শাহনাজ দুই সন্তানের জননী। বড় ছেলে সানজিদুর রহমান সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত রয়েছেন। মেয়ে রাফিয়া বৃষ্টি এবার জয়পুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির মূল ফটকে প্রতিবেশী ও স্বজনেরা ভিড় করছেন। বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।

স্বজনেরা জানান, শাহনাজ আখতারের স্বামী বুলবুল খন্দকার একজন বন কর্মকর্তা। ক্ষেতলাল পৌর শহরের মতিউর মার্কেটে শাহনাজ আখতারের মেয়ের নামে বৃষ্টি ফ্যাশন নামে কাপড়ের দোকান রয়েছে। শাহনাজ আখতার দোকানটি পরিচালনা করতেন। তিনি ঘটনার আগের দিন মেয়ে বৃষ্টির সঙ্গে দেখা করতে জয়পুরহাট শহরে গিয়েছিলেন। তাঁর মেয়ে সেখানে বাসা ভাড়া নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে থাকে। সেখান থেকে গতকাল সকালে অটোরিকশায় চড়ে দোকানে আসছিলেন। তিন-চার মিনিটের পথ পাড়ি দিলেই নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছাতেন তিনি। কিন্তু সেখানে পৌঁছার আগেই প্রাণ হারালেন তিনি।

শাহনাজ আখতারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী সন্ধ্যা রানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপার (শাহনাজ আক্তার) ছেলে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। সব মিলিয়ে তিনি সুখেই ছিলেন।’

শাহনাজ আখতারের স্বামী বন কর্মকর্তা বুলবুল খন্দকার বলেন, ‘ব্যবসা-সংসার সবই একাই সামলাত শাহনাজ। সুখের দিনে সে আর আমাদের সঙ্গে থাকল না।’

এই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া অটোরিকশাচালক আমজাদ হোসেনের বাড়ি শহরের ইটাখোলায়। তিনি দুই সন্তানের বাবা। বড় মেয়ে শাপলা খাতুনের বিয়ে হয়েছে। ছেলে আবদুল্লাহ রিফাত মণ্ডল এবার ক্ষেতলাল পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছে। গতকাল আমজাদ হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষেতলাল সরকারি সৈয়দ আলতাফুন্নেছা সরকারি কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল রিফাতের। কিন্তু দুর্ঘটনায় বাবা মারা যাওয়ায় ওই দিন আর ভর্তি হতে পারেনি সে।

আজ বেলা ১১টায় আমজাদ হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তাঁর স্ত্রী বাড়ির উঠানে বসে ছিলেন। স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। স্বজনেরা জানান, আমজাদ হোসেনের ১০ কাঠা জমি রয়েছে। ব্যাংক ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে অটোরিকশা কিনেছিলেন। অটোরিকশা চালিয়ে ঋণ পরিশোধ ও সংসার চালাচ্ছিলেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মারা যাওয়ায় সংসার চালাতে ভীষণ কষ্ট হবে তাঁর স্ত্রীর।

জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত অটোরিকশার চালক আমজাদ হোসেনের ছেলে, স্ত্রী ও মেয়ে
ছবি: প্রথম আলো

আমজাদ হোসেনের ছেলে আবদুল্লাহ রিফাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত রোববার রাতে আমার বাবা অটোরিকশা নিয়ে সারা রাত ডিউটি করেছিল। এরপর সকালে বাবা জয়পুরহাট গিয়ে ক্ষেতলালের ভাড়া পেয়েছিল। সবশেষ ৯টা ৫৫ মিনিটে বাবা আমাকে মুঠেফোনে বলেছিল, “রেডি থাকো, আমি তোমাকে নিয়ে কলেজে যাব।” ঘণ্টাখানেক পর জানতে পারলাম ট্রাক-অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে বাবা মারা গেছেন।’

ক্ষেতলালের নশিপুর পূর্বপাড়া গ্রামের জামে মসজিদের মোয়াজ্জিম ছিলেন নওগাঁর ধামুইরহাটের চকশরীফ গ্রামের সিরাজুল ইসলাম। তিনি গত শনিবার বাড়িতে গিয়েছিলেন। গতকাল সকালে ফেরার পথে ওই সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। গতকাল আসরের নামাজের পর নশিপুর পূর্বপাড়া জামে মসজিদে জানাজা শেষে রাতে লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। আজ সকাল ১০টায় গ্রামের বাড়িতে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

নশিপুর পূর্বপাড়া গ্রামের জামে মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সোহানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ বছর ধরে সিরাজুল ইসলাম এখানে কাজ করছেন। পরিবারে তাঁর তিন সন্তান রয়েছে। পরিবারের অবস্থা ভালো নয়।

একই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া শাহিনুর আখতারের বাড়ি জয়পুরহাট শহরের বুলুপাড়া মহল্লায়। তিনি ক্ষেতলাল পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের মাঠ সহায়ক পদে কর্মরত ছিলেন। তাঁর স্বামী একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। এক মেয়েসন্তান রয়েছে। সে নবম শ্রেণিতে পড়ে বলে জানিয়েছেন ক্ষেতলাল উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা সেলিনা ইয়াসমীন।

সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া কলেজছাত্র নাফিউস ফুয়াদ জয়পুরহাট শহরে থেকে কোচিং করত। সে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিল। তাকে ঘিরে মা-বাবা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতেন। গতকাল রাতে নাফিউস ফুয়াদের লাশ দাফন করা হয়েছে।
ক্ষেতলাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাজিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল ট্রাক-অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত পাঁচজনের লাশ দাফন করা হয়েছে। এ ঘটনায় ট্রাকচালক ও সহকারীর বিরুদ্ধে থানায় সড়ক পরিবহন আইনে একটি মামলা করা হয়েছে।