মেধার জোরে দিন বদলাতে চায় দিপ্ত

হরিজন সম্প্রদায়ের বলে একদিন রেস্তোরাঁয় খাবার খেতে ঢুকতে পারেনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিপ্ত বাবু। ছোটবেলার সেই স্মৃতি মনে হলে এখনো তার কষ্ট হয়। তাই ভালো চাকরি করে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চায় সে, মর্যাদাপূর্ণ জীবন চায় সে। এ জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশোনা করে যাচ্ছে।

দিপ্তর মতো শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার আবু হানিফ হাসনাত, পাবনার প্রিয়াংকা রানী রায় ও বগুড়ার ধুনটের সাদিয়া ইসলামও চায় লেখাপড়া শিখে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে। তারা চারজনই এবার বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেছে।

দিপ্ত বাবু

মা-বাবার গৌরব দিপ্ত

দিপ্ত বাবু চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাজু ভকত ও জামেলী বাঁশফোরের ছেলে। নাচোল উপজেলা স্কুলে পড়ত সে। এবার রাজশাহীর নিউ ডিগ্রি গভর্নমেন্ট কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।

উপজেলা স্কুলের সহকারী শিক্ষক মজিদুল ইসলাম বলেন, দিপ্ত শুধু মেধাবী ছাত্রই নয়, ভালো বিতার্কিক। জেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে অংশ নিয়েছে। উপস্থিত বক্তৃতায়ও পটু। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারলে সে একদিন অনেক বড় হবে। কিন্তু তাঁর আর্থিক সহায়তা দরকার।

রাজু ভকত বলেন, ‘হামরা দুজনে হাসপাতালে চাকরি করি বুইলে ইচ্ছা হয় ছেলা হামাদের ডাক্তার হোবে। কিন্তুক সে তা চাহে না, সে ইঞ্জিনিয়ার হোইবে।’ জামেলী বাঁশফোর বলেন, ‘হাসপাতালের সবাই বোলছে, সুইপারের ছেলা খুব ভালো রিজাল্ট করিছে। খুব খুশি লাগিছে শুইনে। অর (দিপ্ত) বাবার মতো হামারও ইচ্ছা বেটা ডাক্তার হোক। তেবে বেটার মনে যা ইচ্ছা হয়, তাই হোক। হামাদেরতো সমাজে অনেক ছোট চোখে দেখে। হামরা হোটেলে ঢুকে খাইতে পারি না। হামার বেটা এমন বড় হোক, যানি তাকে কেহু অবহেলা করতে না পারে। হামরা সোমমান চাহি। খায়ে না খায়ে তাই তিন বেটাকেই লিখাপড়া করাই।’

বাংলাদেশ হরিজন সমিতির চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি রাজেন হাড়ি বলেন, ‘আমাদের হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্যে দিপ্ত বাবুই প্রথমবারের মতো এত ভালো রেজাল্ট করেছে। সুযোগ পেলে সে লেখাপড়া করে অনেক দূর যাবে। আমি তার সাফল্য কামনা করি।’

প্রিয়াংকা রানী রায়

থেমে যায়নি প্রিয়াংকা

প্রিয়াংকা রানী রায়ের বাবা উত্তম কুমার রায় টিভি মেকানিক। মা শিল্পী রানী গৃহিণী। একসময় উত্তম ভালো কাজ পেতেন। কিন্তু স্মার্ট টিভি আসার পর প্রযুক্তির সঙ্গে পেরে ওঠেননি। এখন প্রায় কর্মহীন। অভাব-অনটনে চলছে সংসার। দুই মেয়ের একজন স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। ছোট মেয়ে প্রিয়াংকা কলেজে ভর্তি হবে। কিন্তু কীভাবে মেয়েদের পড়ার খরচ জোগাড় করবেন, তা নিয়ে চিন্তিত প্রিয়াংকার মা–বাবা। জেলা শহরের রাধানগর রথঘর পাড়ায় তাঁদের বাড়ি। আর কোনো জমিজমা নেই।

পাবনার আদর্শ গার্লস হাইস্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রিয়াংকা পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। প্রিয়াংকা বলে, ‘বাবার এখন সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। বাবার কাছে বই-খাতা কেনার টাকা চাইতেও কষ্ট লাগে। পড়ালেখা শিখে বড় চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াব।’

মা শিল্পী রানী রায় বলেন, ‘মেয়েডার পড়ার প্রতি খুব ঝোঁক। হেনে (এডওয়ার্ড কলেজে) ভর্তি হতি পারলি বাড়িত থেন হাটে কলেজে যাতি পারবি। কিন্তু ভর্তির টাকা, পড়ার খরচ কোনতেন যোগার হবি, সে চিন্তেয় ঘুম আসে না।’

সাদিয়া ইসলাম

প্রতিদিন ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি

সাদিয়া ইসলামের বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলার চৌকিবাড়ি ইউনিয়নের রুদ্রবাড়িয়া গ্রামে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে ভ্যান করে ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সরকারী নইম উদ্দীন পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয়ে আসা–যাওয়া করত সে। সাদিয়া বলে, সেলাই মেশিন দিয়ে অন্যদের কাপড় তৈরি করে বিদ্যালয়ে যাতায়াতের খরচ জোগাড় করেছে সে। তার বাবা শরিফুল ইসলাম কৃষক। নিজের কোনো জমি নেই। পরের জমিতে কৃষিকাজ করে কোনোরকমে সংসার চলে। মা স্মৃতি খাতুন একজন গৃহিণী।

সাদিয়া বলে, ‘আমাকে নিয়ে বাবার বড় আশা রয়েছে। কৃষি কাজ করে সংসার চলে না। ছোট বোন সুমাইয়া পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। আমার কলেজের ভর্তির টাকা ও বোনের লেখাপড়ার খরচ জোগাবে বাবা কীভাবে? আমার ইচ্ছা প্রকৌশলী হব।’

ধুনট সরকারী নইম উদ্দীন পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তফিজ উদ্দীন বলেন, সাদিয়া মেধাবী শিক্ষার্থী। লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিত সে। সবার সহযোগিতা পেলে তার স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনা রয়েছে।

আবু হানিফ হাসনাত

টিউশনি করে খরচ জোগাড়

আবু হানিফ হাসনাতের বাবা ফরিদ উদ জামান নারায়ণগঞ্জের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সিঙ্গাবরুণা গ্রামে আড়াই শতাংশ জমি ছাড়া আর কিছু নেই তাঁদের। সে জমির ওপর একটি জরাজীর্ণ ঘরে হানিফদের বসবাস। বাবার সামান্য আয়ে সংসারই চলে না। তাই নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় হানিফ গ্রামের বাড়ির আশপাশে টিউশনি শুরু করে।

হানিফ বলে, তাতিহাটী আইডিয়াল হাইস্কুলে পড়ত সে। এখন শেরপুর সরকারি কলেজে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছে। তবে ভর্তির জন্য তিন হাজার টাকা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে জেলা শহরে থেকে পড়ালেখার খরচ জোগানো নিয়েও দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার।

আবু হানিফ বলে, ‘আমার জীবনের লক্ষ্য একজন প্রকৌশলী হওয়ার। কিন্তু টাকার অভাবে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেলে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।’

তাতিহাটী আইডিয়াল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. নূরুজ্জামান বলেন, আবু হানিফ নিজে পরিশ্রম করে টাকা-পয়সা উপার্জন করে পড়ালেখা করেছে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন, আনোয়ার হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ; সরোয়ার মোর্শেদ, পাবনা; দেবাশীষ সাহা রায়, শেরপুর ও মাসুদ রানা, ধুনট, বগুড়া]