অভাব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে শিশুর সমস্যা শনাক্ত করতেই অনেক পরিবারের দেড় থেকে দুই বছর সময় লেগে যায়। 

ভোলার সদর উপজেলার বাসিন্দা মো. মাকসুদ খান একজন শিক্ষক। ছেলের যখন দুই বছর তখন বুঝলেন, ছেলেকে ডাকলে তাকায় না। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মেশে না। অসম্ভব চঞ্চল। তারপর চিকিৎসক দেখিয়ে বুঝলেন, ছেলে অটিজমে আক্রান্ত। সামাজিক কুসংস্কার উপেক্ষা করে ভারতে নিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

মাকসুদ খান বলেন, তিনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ভোলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-থেরাপিস্ট ও সরঞ্জামের অভাবে মাঝেমধ্যে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। ভোলায় বসে অটিস্টিক শিশুর চিকিৎসা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। এখানে যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পাশাপাশি পর্যাপ্ত সহায়ক উপকরণ দরকার।

এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ ২ এপ্রিল সারা দেশে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হবে। দিনটি উপলক্ষে ভোলায় শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভা করা হবে। এবারের প্রতিপাদ্য, ‘নারী ও বালিকাদের ক্ষমতায়ন, হোক না তারা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন’।

জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ভোলায় মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৫৮ হাজার ৩৪০। এর মধ্যে মাসে ৮৫০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছে ৪০ হাজার ২৪ জন। ভোলা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয় এবং ভোলা’স চিলড্রেন স্কুলে প্রায় ২৫ জন অটিস্টিক শিশুকে শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের পরিবারের সদস্যদের কাউন্সেলিং করানো হচ্ছে। 

■ ভোলায় মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৫৮ হাজার ৩৪০। এর মধ্যে মাসে ৮৫০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছে ৪০ হাজার ২৪ জন।

■ ভোলা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয় এবং ভোলা’স চিলড্রেন স্কুলে প্রায় ২৫ জন অটিস্টিক শিশুকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।

ভোলা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশারেফ লাবু বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে শিশুর সমস্যা শনাক্ত করতেই অনেক পরিবারের দেড় থেকে দুই বছর লেগে যায়। বিষয়গুলো নিয়ে সন্দেহ হলেও পরিবার বুঝতে পারে না, কী করতে হবে। চিকিৎসকের কাছ থেকে সঠিক পরামর্শ সবাই পান না। পরামর্শ পেলেও সঠিক তদারক করানো যাচ্ছে না বিশেষজ্ঞের অভাবে। 

অটিজমে আক্রান্ত শিশুর বাবা মাকসুদ খান বলেন, তাঁর ছেলের যখন বয়স দেড়-দুই বছর, তখন একবার খিঁচুনি হয়। শিশুরোগবিশেষজ্ঞ আবদুল কাদেরের কাছে নিয়ে যান। তিনি ওষুধ দেওয়ার পর আর খিঁচুনি হয়নি। দুই বছর বয়সের আগে বুঝতে পারেন, ডাকলে তাকায় না। নিজের মতো করে চলে। একটি স্বাভাবিক শিশুর যে উন্নয়ন, তা ওর মধ্যে ছিল না। আড়াই বছর পর্যন্ত ভোলার সব শিশুরোগবিশেষজ্ঞকে দেখানো হয়েছে। তাঁরাই পরামর্শ দিলেন, ঢাকায় নিয়ে দেখাতে। তবে করোনার কারণে ঢাকায় যেতে কিছুটা দেরি হয়ে যায়।

মাসুদ খান বলেন, ‘আমরা ছেলের তিন বছর শেষ হওয়ার পর ঢাকা নিয়ে যাই। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসক জানান, ওর অক্সিজেনের প্রবলেম আছে। অটিজমের লক্ষণ আছে। তখন তাঁরা সিআরপিতে (পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র) রেফার করে। কিন্তু খুব ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছিল। পরে ৪ বছর বয়সে ভারতে নিয়ে যাই। তাঁরা অনেকগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ লিখে দেন। সেই ওষুধ এখনো খাওয়াচ্ছি, সঙ্গে থেরাপি দিচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ছেলের সাড়ে ছয় বছর চলছে। যথাসময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার কারণে ছেলের উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু এখনো কথা বলতে পারে না। ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করেছেন। সিআরপি থেকে শিখিয়ে দেওয়া ব্যায়াম বাসায় নিয়মিত করান। ভোলার কোথাও স্পিচ থেরাপি (বচন) বিশেষজ্ঞ নেই। আবার ভোলার প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক স্কুলে অনেক সহায়ক উপকরণ নেই। এগুলো থাকলে ছেলের আরও তাড়াতাড়ি উন্নয়ন হতো।

ভোলা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জহিরুল ইসলাম কবির বলেন, তাঁদের তিনজন শিক্ষক, একজন ভ্যানচালক ও দুজন আয়ার বেতন ছাড়া স্কুল চালানোর কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয় না। এখানে ১১০ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ১২ জন অটিজম আক্রান্ত। শিক্ষক, ফিজিও থেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট, বিশেষজ্ঞ সংগীতশিল্পী, অফিস সহকারী, আয়া ভ্যানচালক সব মিলিয়ে ১৮ জন দরকার। দরকার পর্যাপ্ত সহায়ক উপকরণ ও শ্রেণিকক্ষ। এখন যে কক্ষ আছে, তাতে ২০ জন শিক্ষার্থী বসতে পারে।

ভোলা’স চাইল্ড স্কুলের প্রধান জাকির হোসেন বলেন, তাঁদের ফিজিও ও স্পিচ থেরাপিস্ট দরকার। বিদেশিদের দেওয়া সীমিত বাজেটে চলতে হচ্ছে। ১০০ শিশুর থাকা, খাওয়া, খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকলেও পর্যাপ্ত বাজেট নেই। সরকার থেকে কোনো সহায়তা তাঁরা পান না। 

সদর হাসপাতালের সামনে সমাজসেবার একটি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র রয়েছে। সেখানকার প্রধান সাইদুর রহমান বলেন, অটিজম শিশু শনাক্ত করতে তিনজনের একটি দল দরকার। একজন শিশুরোগবিশেষজ্ঞ, একজন সাইক্রিয়াটিস্ট ও একজন অটিস্টিক বিশেষজ্ঞ। ভোলায় এই তিনের সমন্বয় করা যাচ্ছে না। প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে ক্লিনিক্যাল স্পিচ থেরাপিস্ট ও ক্লিনিক্যাল ফিজিওথেরাপিস্ট পদগুলো শূন্য। নিজে যতটুকু জানেন, তা-ই দিয়ে সেবা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ভোলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক কাজী গোলাম কবির বলেন, তাঁরা প্রতিবন্ধীসহ অটিজম শিশুদের উন্নয়নে নানা সহায়তা দিচ্ছেন। তবে অটিজম-বিশেষজ্ঞ; বুদ্ধি, দৃষ্টি, বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী বিশেষজ্ঞ ও থেরাপিস্ট নিয়োগ করা দরকার। এ ছাড়া ইশারা ভাষা কার্যক্রম চালু দরকার। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে কুসংস্কার দূর করে মানুষের প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহমর্মিতা বাড়ানো দরকার।