আধা পাকা ধান কাটছেন কৃষক

শিলাবৃষ্টির আতঙ্কে আধা পাকা ধান কেটে ফেলছেন অনেকে। গত শুক্রবার মৌলভীবাজারের বড়লেখার হাকালুকি হাওরপারের মুর্শীবাদকুরায়।ছবি: প্রথম আলো

এবার মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরে বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। চারদিকে পাকা, আধাপাকা ধান খেতে মনভোলানো ঢেউ। এর মধ্যে বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টির ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে পাহাড়ি ঢলে ফসল তলিয়ে যাওয়ার এবং শিলাবৃষ্টিতে ধান ঝরে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই ঝুঁকি নিতে চাইছেন না হাওরপারের কৃষকেরা। আধাপাকা ধানই কাটতে শুরু করেছেন তাঁরা। হাওরজুড়ে এখন ধান কাটা আর গোলায় ধান তোলার ব্যস্ততা।

বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওরপারের বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, হাওরপারের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে হালকা সবুজ, সোনালি রঙের ধান ছড়িয়ে আছে। বাতাসে দুলছে। মাঝেমধ্যে কৃষকেরা ধান কাটছেন। কোনোদিকে তাকানোর সুযোগ তাঁদের নেই। কাটা ধান কাঁধভারে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। কোথাও কেটে আনা ধানের আঁটি স্তূপ করে রাখা হয়েছে। কোথাও ধান মাড়াই চলছে। নারী-পুরুষ মিলে ধান ঝাড়াই হচ্ছে। বস্তা ভরে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ধান। কোথাও ধান সেদ্ধ করা হচ্ছে। হাওরপারে উৎসবের মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কৃষকদের কাছে গোলায় ধান তোলার মতো উৎসব হয়তো আর নেই। শ্রমের মধ্যে এত আনন্দও আর কিছুতে নেই।

কৃষি বিভাগ, কৃষক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এবার হাকালুকি হাওরে সময়মতো বৃষ্টি হওয়ায় ধানের ফলন প্রত্যাশামতো হয়েছে। রোগ-বালাইও হয়নি। ঘরে ধান তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কৃষকেরা। কিন্তু অনেক খেতেই ধান সম্পূর্ণ পাকেনি। চার-পাঁচটা দিন সময় পেলে সম্পূর্ণ ধান পেকে যেত। কৃষকেরা এই সময়টুকু দিতে পারছেন না। কেননা প্রায়ই বৃষ্টি নামছে, শিলাবৃষ্টি ঝরছে। তাই আধাপাকা ধানই কেটে ঘরে তুলছেন কৃষকেরা। এখন যেটুকু ধান মিলছে, আকস্মিক বন্যা হলে সেটুকুও পাওয়া যাবে না বলে শঙ্কা তাঁদের।

এরই মধ্যে বৃষ্টিতে হাকালুকি হাওরের জলারবিল, মাইজম বিল এলাকাসহ নিচু এলাকা, বিলের আশপাশের অনেক জমি পানিতে তলিয়েছে। এতে অন্তত ১৫ হেক্টর জমির ধান ডুবে গেছে। অন্যদিকে শিলাবৃষ্টিতেও খেতের ফসল নষ্ট হয়েছে। শিলাবৃষ্টি অবশ্য ৩০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিটের বেশি হয়নি। তাতেও খেতের পাঁচ শতাংশের বেশি ধান ঝরে গেছে। শিলাবৃষ্টির আতঙ্কে আধাপাকা ধান নিয়ে কৃষকেরা কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নন।

হাকালুকি হাওরপারের হাল্লা এলাকার কৃষক জাকির হোসেন জানিয়েছেন, হাওরের দুধাই বিলে প্রায় ৩০ কিয়ার (১ কিয়ার=৩০ শতক) জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। নিচু এলাকা হওয়ায় সম্প্রতি ভারী বর্ষণে প্রায় ২০ কিয়ারের ধান তলিয়ে গেছে। কিছু ধান আগে শিলাবৃষ্টিতে ঝরে পড়েছে। বন্যার ভয়ে আধাপাকা ধান কেটে ফেলছেন। ঋণ করে চাষ করেছেন, তাই আর কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। তিনি জানান, তাঁর মতো আরও অনেক কৃষকের ধান পানিতে তলিয়ে গেছে।

কলারতলিপারের বর্গাচাষি মোহাম্মদ মতিউর রহমান বলেন, ‘ধানের ফলন ভালা অইছে (হয়েছে)। তবে কয়েক দিন আগের শিলাবৃষ্টিতে আমার জমির ধান ঝরি (ঝরে) গেছে। এর মধ্যে বন্যার ভয় আছে। তাই ভয়ে আধাপাকা ধান কাটি লাইছি (কেটে ফেলছি।’

বর্গাচাষি জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছে, তাঁর প্রায় ১২ কিয়ার জমিতে ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তবে কিছু ধান শিলাবৃষ্টিতে ঝরে পড়েছে। এখনো ধান কাটেননি। দ্রুতই কেটে ফেলবেন।

মুর্শীবাদকুরা গ্রামের আশরাফুল আলম ও মাশরাফি আহমদ ধানের গোছা দেখিয়ে জানান, গাছে অনেক ধান ধরেছে। ফলন বেশ ভালো হয়েছে। তবে শিলের ভয়ে তাঁরা আধাপাকা ধান কেটে ফেলছেন। বড়ময়দান এলাকায় রাস্তার পাশে মেশিন দিয়ে ধান মাড়াই চলছে। সেখানে উপস্থিত কৃষক মুজিবুর রহমান, ইউসুফ আলী, ফরিজ আলী প্রমুখ জানিয়েছেন, শিলাবৃষ্টিতে তাদের সবার কিছু ক্ষতি হয়েছে। তাদের কেউ ধান এখনো কাটেননি, কেউ কেটে ফেলেছেন।

বড়লেখা উপজেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, উপজেলার হাকালুকি হাওরে প্রায় ৬০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। এ বছর বড়লেখা উপজেলায় ৫ হাজার ৪২৩ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে হাকালুকি হাওরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর। এবার মৌসুমে বৃষ্টি হওয়ায় হাওর এলাকায় গত বছরের চেয়ে প্রায় ৫০ হেক্টর বেশি জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি চাষ হয়েছে ব্রি ধান-৮৮, ৮৯, ৯২, ৯৬ ও বঙ্গবন্ধু-১০০ জাতের। এ ছাড়া ব্রি ধান-২৮, ২৯, ৫৮ ও হাইব্রিড জাতের ধানও আছে। স্থানীয় জাতের মধ্যে খৈয়া বোরো, টেপা বোরো, লাখাই জাতের ধানের চাষ হয়েছে। ধানের ফলনও ভালো হয়েছে। কিয়ারে ২০ থেকে ২৫ মণ ধান মিলছে।

বড়লেখা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনোয়ার হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার ফসল মোটামুটি ভালো হয়েছে। তবে বৃষ্টির পানিতে হাওরের বিলের পাশে ১০ থেকে ১৫ হেক্টর জমি সম্পূর্ণ ডুবে গেছে। যতটুকু পারছে কৃষক কেটে নিয়ে আসছেন। ঘনঘন বৃষ্টি হচ্ছে। ধাপে ধাপে শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। গতকালকেও (গত সোমবার) ৩০ সেকেন্ড শিলাবৃষ্টি হয়েছে। তাই কৃষকেরা ঝুঁকি নিচ্ছেন না। তাঁরা আধাপাকা ধান কেটে নিচ্ছেন। যে ধান চার-পাঁচ দিন পরে কাটলে সম্পূর্ণ পেকে যেত।’