১৩২ বছরের চড়ক মেলায় হাজারো মানুষের সমাগম

চড়ক পূজার মূল আকর্ষণ চড়ক ঘুল্লি দেখতে কয়েক হাজার ভক্ত-দর্শনার্থী সমবেত হন। খুলনার দাকোপ উপজেলার দাকোপ শিংজোড়া গ্রামের মণ্ডলবাড়ি শিববাড়ি প্রাঙ্গণে শনিবার
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

বাজছে ঢাকঢোল। চলছে শঙ্খ আর উলুধ্বনি। হাজারখানেক মানুষ অপলক তাকিয়ে ৩০ ফুট উচ্চতার একটি  দণ্ডের দিকে। তিনজন মানুষ বনবন করে শূন্যে ঘুরছেন আলাদা তিনটি রশিতে ঝুলে। রশিতে ঝুলে থাকা তিনজন তাঁদের সঙ্গে থাকা ফুল-জল, কাঁচা আম, ফল, আবির, বাতাসা, নকুলদানা ইত্যাদি ছিটিয়ে দিচ্ছেন অগণিত ভক্ত-দর্শকের দিকে।

খুলনার দাকোপ উপজেলার দাকোপ শিংজোড়া গ্রামের মণ্ডলবাড়ি শিববাড়ি প্রাঙ্গণে শনিবার বসেছে এ চড়ক মেলা।

ওই তিনজন যেখানে ঘুরছিলেন, সেটি ঘূর্ণনের জন্য পোঁতা কাঠের দণ্ডটি মাঠের মাঝখানে বসানো। ওই কাঠের ওপর চরকির মতো আড়াআড়িভাবে বসানো আরও দুটি বাঁশের খণ্ড। সেই আড়াআড়িভাবে থাকা বাঁশের খণ্ডের প্রান্ত থেকে মাটি পর্যন্ত ঝোলানো চারটি লম্বা দড়ি। ৩০ ফুট লম্বা কাঠের দণ্ডের ঠিক নিচে একদল মানুষ শক্ত হাত দিয়ে ঘোরান ওই চার দড়ির একটা দড়ি। বাকি তিন দড়িতে ঝুলতে থাকেন সন্ন্যাসীরা। এটাই চড়কপূজার মূল আকর্ষণ।

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, ১৩২ বছরের পুরোনো এ চড়কপূজা ও মেলা। পূজার মূল আকর্ষণ চড়ক ঘুল্লি দেখতে কয়েক হাজার ভক্ত-দর্শনার্থী সমবেত হন। পূজা কেন্দ্র করে বসে গ্রামীণ মেলা। আগে সাত দিন ধরে মেলা চলত। তবে এখন এলাকার প্রধান ফসল তরমুজ ওঠানোর সময় বলে মেলার সময় কমিয়ে আনা হয়েছে। এবার এক দিনের মেলা হচ্ছে।

দাকোপ সদর ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও আয়োজক কমিটির সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত মণ্ডল বলেন, বাংলা ১৩৯৮ সনে এ এলাকায় জনবসতি গড়ে ওঠে। জনবসতি গড়ার সময় থেকে এখানে এ চড়কপূজা হচ্ছে। সে হিসাবে এই পূজার বয়স ১৩২ বছর। সপ্তাহখানেক আগে থেকেই চড়ক উৎসবের আয়োজন শুরু হয়। ধর্মানুরাগী ‘সন্ন্যাসীরা’ বাড়ি বাড়ি গিয়ে  চড়কপূজার জন্য চাল ও অর্থ সংগ্রহ করেন। সন্ন্যাসীদের পাশাপাশি আরেকটি দল বাড়ি বাড়ি নৃত্যগীতের মাধ্যমে অষ্টক বা বালাগান পরিবেশন করেন। চড়কপূজার ঠিক এক দিন আগে একজন সন্ন্যাসী উল্টোভাবে খেজুরগাছের মাথায় উঠে খেজুর সংগ্রহ করেন, যা চড়কপূজায় ব্যবহৃত হয়।

চলছে নানা আনুষ্ঠানিকতা। খুলনার দাকোপ উপজেলার দাকোপ শিংজোড়া গ্রামের মণ্ডলবাড়ি শিববাড়ি প্রাঙ্গণে
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

শনিবার বিকেলে ওই মেলায় গিয়ে দেখা গেল, ‘পাটারভাঙ্গা’ দেখতে অনেক মানুষের ভিড়। মূল মন্দির থেকে কিছুটা দূরে বাঁশ দিয়ে ৩০-৪০ ফুট  উঁচুতে একটি ‘তাড়া’ বানানো হয়েছে। সেখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন ‘সন্ন্যাসীরা’। নিচে কয়েকজন জাল পেতে রাখেন। ‘তাড়া’ থেকে যখন সন্ন্যাসীরা ঝাঁপ দেন, তখন মন্দিরের সামনে থেকে একজন নাচতে নাচতে লোহার পাট নিয়ে সন্ন্যাসীর বুকের নিচে ধরেন। পুণ্যার্থী-দর্শকেরা হর্ষধ্বনি দিয়ে সন্ন্যাসীদের উৎসাহ দিতে থাকেন। এটাকেই পাটারভাঙ্গা বলা হয়।

উৎসব আয়োজক কমিটির কোষাধ্যক্ষ মনোরঞ্জন মণ্ডল বলেন, তাঁর সাত প্রজন্ম আগে থেকে এ পূজা চলে আসছে। প্রতিবছরের পূজা শেষে শিবমন্দিরের দিঘিতে ডুবিয়ে রাখা চড়কগাছ প্রতিবছর নতুন পূজার সময় তুলে আনা হয়। মাঠের মাঝখানে গর্ত করে খাড়া করে বসানো হয় এ চড়কগাছ। মেলায় বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বসে দোকান। থাকে সাংস্কৃতিক আয়োজন।

মেলায় দোকান নিয়ে বসা একজন রামপ্রসাদ মোড়ল বলেন, ‘প্রতিবছর এখানে দোকান নিয়ে বসি। এখন মেলা মাত্র এক দিন হয়। কয়েক ঘণ্টার এই মেলায় ব্যাপক কেনাবেচা হয়।’

উৎসব প্রাঙ্গণ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের সুতারখালী গ্রাম থেকে মেলা দেখতে আসা সুমিত্রা মণ্ডল বলেন, ‘পরিবার, স্বজন, প্রতিবেশী সবাই মিলে ৫০ জনের মতো একটা ট্রলার নিয়ে মেলা দেখতে এসেছি। চড়ক ঘুল্লি দেখতে ভালো লাগে। মেলায় পরিচিত স্বজন অনেকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সব মিলিয়ে এটা একটা দারুণ আয়োজন।’