নৌকা ও ট্রাকের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস

শহীদুজ্জামান ও এইচ এম আখতারুল আলম

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্থগিত হয়ে যাওয়া নওগাঁ-২ (পত্নীতলা ও ধামইরহাট) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শহীদুজ্জামান সরকারের জন্য ভোটের মাঠে চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী এইচ এম আখতারুল আলম। বিএনপি-জামায়াত এই নির্বাচন বর্জন করলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর শক্ত অবস্থানের কারণে জমে উঠেছে প্রচার-প্রচারণা। শুরুর দিকে ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ কম থাকলেও শেষ মুহূর্তে দুই প্রার্থীর জমজমাট প্রচার-প্রচারণায় ভোটারদের সম্পৃক্ততাও বেড়েছে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য এইচ এম আখতারুল আলম ট্রাক প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। ভোটের মাঠে অন্য দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হলেন—জাতীয় পার্টির তোফাজ্জল হোসেন ও স্বতন্ত্র (ঈগল) প্রার্থী আওয়ামী লীগের নেতা মেহেদী মাহমুদ রেজা।

আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে সংঘাতের উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা না ঘটলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী এইচ এম আখতারুল আলমের অভিযোগ, নৌকা প্রার্থীর অনুসারী নেতা-কর্মীরা তাঁর কর্মী-সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে যেতে নিষেধ করেছেন। ভোটকেন্দ্রে গেলে ভোটের পরে ওই সব ভোটারের নানাভাবে ক্ষতি করা হবে বলে হুমকি দিচ্ছেন নৌকা প্রার্থীর অনুসারী নেতা-কর্মীরা।

এ আসনে ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শহীদুজ্জামান সরকার। এরপর ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী সামসুজ্জোহার কাছে তিনি হেরে যান। পরবর্তী সময় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করে ২০০৮ সাল থেকে টানা তিনবার তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবারও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন।

গত সোমবার ও গতকাল মঙ্গলবার পত্নীতলা ও ধামইরহাট উপজেলার অন্তত পাঁচটি ইউনিয়ন এবং দুটি পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে সাধারণ ভোটার, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী সোমবার অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নওগাঁ-২ আসনের নির্বাচনে নৌকা ও ট্রাকের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।

পত্নীতলা উপজেলার নজিপুর পৌরসভার জিরো পয়েন্ট এলাকার একটি চায়ের দোকানে বসে চা–পান করছিলেন নানা বয়সী ছয় থেকে সাতজন। আড্ডার মূল বিষয়, সোমবারের নির্বাচন। কারও মুখে নৌকার প্রার্থী শহীদুজ্জামান সরকারের গুণগান, আবার কারও মুখে স্বতন্ত্র প্রার্থী আখতারুল আলমের গুণগান।

ষাটোর্ধ্ব হাকিম মণ্ডল বলে উঠলেন, ‘পত্নীতলা-ধামইরহাটে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সমানে-সমান। বিএনপি না এলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর এবার ঘুম নাই। এখানে আওয়ামী লীগের যত ভোট আছে, সেই ভোটগুলো ভাগাভাগি হয়ে গেছে। এবার ভোটত অনেক হিসাব-নিকাশ হবে। নৌকা কিংবা ট্রাক, যেই জিতুক না ক্যান, অনেক কম ভোটের ব্যবধানে জিতবে।’

রফিকুল ইসলাম নামের এক যুবক বলেন, ‘এবার ভোটত খেলা ভালোই জমিছে। আগের মতো নৌকা আর ফাঁকা মাঠত গোল দিতে পারতেছে না। শেয়ানে-শেয়ানে লড়াই হবে। নৌকার সঙ্গে ঈগলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে প্রতিটি কেন্দ্রে।’

ভোটের এই আলোচনা পত্নীতলা ও ধামইরহাট উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে। নজিপুর পৌরসভার কলেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা কলেজশিক্ষক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে লোকজনের মধ্যে একটা উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল। ভোট স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর ভোট নিয়ে মানুষের তেমন আগ্রহ ছিল না। ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রচারণা ততই জমজমাট হচ্ছে। ভোটারদের মধ্যে ভোট নিয়ে আগ্রহও বাড়ছে। মনে হচ্ছে, ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ভালোই হবে।’

ধামইরহাট পৌরসভার আমাইতাড়া এলাকার বাসিন্দা আবুল হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন এখানে জমজমাট হবে। এখন পর্যন্ত বড় ধরনের সংঘাত না হলেও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। এতে সাধারণ ভোটার যাঁরা আছেন, তাঁদের মনে ভয়ও আছে। ভোট নিয়ে নৌকার সঙ্গে ট্রাক প্রার্থীর অনুসারীদের কোনো সংঘর্ষ হয় কি না, তা নিয়ে সবাই চিন্তিত। কারণ, নৌকা কোনোভাবেই আসন হারাতে চাইবে না।’

স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আইয়ুব হোসেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী টানা তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা–কর্মী ও সাধারণ জনগণের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। মানুষ পরিবর্তন দেখতে চায়। এবারের নির্বাচনে বারো আনা লোকই ট্রাকের পক্ষে। ট্রাকের জনপ্রিয়তা দেখে নৌকার প্রার্থীর অনুসারী নেতা–কর্মীরা ভোটারদের হুমকি দিচ্ছেন, ভোটাররা যাতে ভোটকেন্দ্রে না যান।

নৌকার প্রার্থী শহীদুজ্জামান সরকারের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ধামইরহাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শহীদুজ্জামান সরকার পত্নীতলা ও ধামইরহাটের মানুষের ভোটে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ট্রাক মার্কায় কিছু ভোট পড়তে পারে। তবে এখানে আবারও নৌকাই জিতবে। আমরা নৌকার পক্ষে আচরণবিধি মেনে প্রচারণা চালাচ্ছি। ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে হুমকি দেওয়ার যে অভিযোগ করা হচ্ছে, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। বরং ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে আমরা কাজ করছি।’

নওগাঁ-২ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৫৬ হাজার ১৩২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৭৭ হাজার ৫৭২ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫৫৯ জন।