টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক হত্যা মামলার রায়ে বিস্মিত সন্তানেরা, যাবেন উচ্চ আদালতে
টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার রায়ে ন্যায়বিচার পাননি বলে মনে করছেন সন্তানেরা। মামলার প্রধান আসামি আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান (রানা) ও তাঁর ৩ ভাইসহ ১০ জন বেকসুর খালাস পাওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তাঁরা। নিম্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
আজ রোববার বিকেলে আলোচিত ফারুক হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন টাঙ্গাইলের প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. মাহমুদুল হাসান। এতে দুজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। তাঁরা হলেন মোহাম্মদ আলী ও কবির হোসেন। মামলার প্রধান আসামি আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) আমানুর রহমান খান রানা, তাঁর তিন ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান (মুক্তি), ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান (কাকন) ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সানিয়াত খানসহ (বাপ্পা) ১০ জনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত। ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
রায় ঘোষণার পর ফারুক আহমেদের ছেলে আহমেদ মজিদ (সুমন) প্রথম আলোকে বলেন, মামলা দায়ের থেকে তদন্ত, আদালতে অভিযোগ গঠন, সাক্ষী গ্রহণ বিভিন্ন পর্যায়ে আসামিরা বিচারপ্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁরা পদে পদে প্রভাব খাটিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, এই মামলার আসামিপক্ষে আইনজীবী ছিলেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী নেতারা। তাঁরা ৫ আগস্টের পর আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এই সব আইন কর্মকর্তা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। এর আগেও যাঁরা রাষ্ট্রপক্ষে কাজ করেছেন, তাঁরা আমানুরদের ভয়ে স্বাভাবিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি।
ফারুক আহমেদের মেয়ে ফারজানা আহমেদ বলেন, ‘নিম্ন আদালতে আমরা সঠিক বিচার পাইনি। তাই বলে আমরা হতাশ নই। এই মামলার বাদী আমার মা খুনিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে গত বছর মারা গেছেন। আমরা উচ্চ আদালতে আপিলের ব্যবস্থা করব। সেখানে নিশ্চয়ই ন্যায়বিচার পাব।’
ফারুক আহমেদের ছেলেমেয়েরা বলছেন, যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত মোহাম্মদ আলী আদালতে স্বীকারোক্তিতে বলেছিলেন ফারুক আহমেদকে গুলি করেন কবির। সেখানে আমানুর রহমান খান ও সানিয়াত খান উপস্থিত ছিলেন। মোহাম্মদ আলী ও আনিসুল ইসলামের (রাজা) স্বীকারোক্তিতে আরও বের হয়ে আসে যে এই হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আমানুরের অপর দুই ভাই সহিদুর রহমান খান ও জাহিদুর রহমান খান জড়িত। আনিসুল ইসলাম কারাগারে মারা গেছেন। এই স্বীকারোক্তির কারণে মোহাম্মদ আলী ও কবিরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো। কিন্তু আমানুর ও তাঁর ভাইদের কিছুই হলো না কেন?
রোববার ফারুক হত্যা মামলার রায় ঘোষণার সময় আমানুর রহমান খানের ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খানকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। কিন্তু অন্য তিন ভাইসহ আট আসামি অনুপস্থিত ছিলেন। আমানুর ২০১৬ সালে আত্মসমর্পণ করে প্রায় তিন বছর হাজতবাসের পর জামিনে মুক্ত হন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। ২০১৪ সালে পুলিশি তদন্তে এই মামলায় আমানুর ও তাঁর ভাইদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বের হয়। তার পরেই তাঁদের দুই ভাই ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা দেশ ত্যাগ করেন বলে ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে।
রায় ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি) সাইদুর রহমান বলেন, দণ্ডিত দুজনকে পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের ব্যাপারে তাঁরা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।
ফারুক আহমেদের সন্তানদের অভিযোগ প্রসঙ্গে সাইদুর রহমান বলেন, তিনি শেষ পর্যায়ে এসে মামলাটি পরিচালনার দয়িত্ব পেয়েছেন। তিনি শুধু যুক্তিতর্ক করেছেন। সাক্ষী নিয়েছিলেন আগের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি। তিনি কখনো এই মামলার আসামি পক্ষে ছিলেন না।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি ফারুক আহমেদের গুলিবিদ্ধ লাশ তাঁর কলেজপাড়া এলাকার বাসার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। ঘটনার তিন দিন পর তাঁর স্ত্রী নাহার আহমেদ বাদী হয়ে টাঙ্গাইল সদর থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন। ২০১৪ সালের আগস্টে এই হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আনিসুল ইসলাম ওরফে রাজা ও মোহাম্মদ আলী নামের দুজনকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাঁরা আদালতে জবানবন্দি দেন। তাঁদের জবানবন্দিতে আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খানসহ তাঁর ভাইদের নাম উঠে আসে।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম মাহফীজুর রহমান বলেন, ২০১৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি আমানুররা ৪ ভাইসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। গত ২৬ জানুয়ারি ফারুক হত্যা মামলার যুক্তিতর্ক শেষ হয়। রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বহুল আলোচিত এই মামলার নিম্ন আদালতে বিচারকাজ শেষ হলো।