‘গরিব’ খায়েরের ‘লৌহ হসপিটালের’ ব্যতিক্রমী সাইনবোর্ড

নিজের প্রতিষ্ঠানে এমন সাইনবোর্ডই টানিয়েছেন আবুল খায়ের। সম্প্রতি বরগুনা জেলা শহরের সিরাজউদ্দীন সড়কে
ছবি: প্রথম আলো

রিকশায় যেতে যেতে একটি সাইনবোর্ডে চোখ আটকে গেল। রিকশা ঘুরিয়ে নেমে লেখাগুলো পুনরায় পড়ে বিশ্বাস হচ্ছিল না। প্রতিষ্ঠানের নাম ‘মেসার্স লৌহ হসপিটাল’। এর স্বত্বাধিকারীর নাম লেখা হয়েছে ‘মো. আবুল খায়ের (গরিব ও অশিক্ষিত)’। প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে—‘এখানে অদক্ষ কারিগর, কাজের কোনো গ্যারান্টি-ওয়ারেন্টি নাই’। বিশেষ দ্রষ্টব্যে লেখা হয়েছে—‘আপনার কাজ না করানো ভালো, কারণ, রেট বেশি’। এরপর লেখা হয়েছে মুঠোফোন নম্বর।

কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচিতির জন্য টানানো সাইনবোর্ডে সাধারণত গুণাবলির কথাগুলো লেখা থাকবে। কিন্তু গুণাবলির বদলে প্রতিষ্ঠানের দুর্নাম লেখা সাইনবোর্ড! কৌতূহল বাড়তে থাকে। আসলেই কি মালিক নিজেই এই সাইনবোর্ড টানিয়েছেন, নাকি অন্য কেউ। এই সন্দেহ আরও বাড়ে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ থাকায়।

সম্প্রতি বরগুনা জেলা শহরের সিরাজউদ্দীন সড়কের প্রাচীন সিরাজউদ্দীন মিলনায়তন বা টাউন হল এলাকায় অবস্থিত বাসস্ট্যান্ডের টিনের ঘরে ছোট্ট একটি কক্ষে এই ‘লৌহ হসপিটালের’ দেখা মেলে। কৌতূহলবশত সাইনবোর্ডে থাকা নম্বরে ফোন করে পাওয়া গেল মালিক আবুল খায়েরকে। পরিচয় দিয়ে সাইনবোর্ডের রহস্য জিজ্ঞাসা করলে তিনি অকপটে বললেন, ‘হ্যাঁ, এটা আমিই টানিয়েছি।’ এবার তাঁর সঙ্গে দেখা ও কথা বলার আগ্রহ তুঙ্গে ওঠে।

আমি খেটে খাই, তাই গরিব। এসএসসি পর্যন্ত পড়েছি, এটা তো কোনো যোগ্যতা না। ওই পড়াশোনা আমার জীবিকায় কোনো কাজে দেয়নি।
আবুল খায়ের

পরের দিন বিকেলে আবার দোকানটিতে গিয়ে পাওয়া গেল এই খায়েরকে। তিনি দোকানে বসে কাজ করছিলেন। মূলত মোটর, ফ্যান, রেডিয়েটর, গ্যাস ওয়েল্ডিংসহ ইলেকট্রিক্যাল নানা কাজ করেন। আবুল খায়ের একাই প্রতিষ্ঠানটি চালান। কোনো কর্মচারী বা সহযোগী নেই। আলাপের সূত্র ধরে কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন।

মোটর, ফ্যান, রেডিয়েটর মেরামত, গ্যাস ওয়েল্ডিংসহ ইলেকট্রিক্যাল নানা কাজ করেন আবুল খায়ের
ছবি: প্রথম আলো

কেন নিজেকে গরিব ও অশিক্ষিত লিখলেন, এমন প্রশ্ন শুনে মাথা তুললেন তিনি। কাটখোট্টা জবাব, ‘আমি খেটে খাই, তাই গরিব। এসএসসি পর্যন্ত পড়েছি, এটা তো কোনো যোগ্যতা না। ওই পড়াশোনা আমার জীবিকায় কোনো কাজে দেয়নি। হাতের কাজ শিখেছি, সেটাই আমাকে পথ চলতে সাহায্য করছে।’

তাহলে আপনি তো গরিব ও অশিক্ষিত নন, প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসেন খায়ের। বলেন, ‘ভাই, গরিব হওয়া অন্যায় না, আমি যা, তা–ই বলেছি, ভণিতা করে লাভ কী! আর প্রচলিত মানদণ্ডে শিক্ষিত বলতে আমাদের দেশে বোঝানো হয় যিনি ডিগ্রির সনদধারী। তিনি কাজ পারুন আর না পারুন, তাতে সমস্যা নেই, তিনিই শিক্ষিত। আমি তা নই।’

সাইনবোর্ডে দুর্নাম লেখার কারণ জানতে চাইলে আবুল খায়েরের জবাব, ‘প্রবাদ আছে না, আগে তিতা ভালো, তারপর মিঠা। আমি কেমন লোক, সেটা আমার গ্রাহকেরা জানেন। তাই আগেই তিতাটা লিখে দিয়েছি। এসব শুনে যাঁর ভালো লাগবে, তিনি আসবেন, যাঁর লাগবে না, তিনি আসবেন না। কাজের ব্যাপারে কোনো জোরাজুরি নেই।’ এরপরও গ্রাহক বেড়েছে, না কমেছে? এ প্রশ্ন শুনে তিনি শুকনা মুখে আবার হাসি দিয়ে বলেন, এই চলে যায় আর কী!

খায়েরের বাড়ি ভোলায়। কাজের সুবাদে তিনি বছর ২৫ আগে পাড়ি জমান বরগুনায়। এরপর বিয়ে করে এখানেই থিতু হন। শহরের উপকণ্ঠে ক্রোক এলাকায় ৩০ শতক জমি কিনে সেখানে ঘর করেছেন। তিন ছেলেমেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় থাকেন। এরপর ছেলে নাইমুল ইসলাম এলএলবি করেছেন। এখন ঢাকায় ব্যবসা করেন। আর ছোট মেয়ে তেজগাঁও কলেজে স্নাতকোত্তরে পড়ছেন এবং পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে চাকরি করছেন। খায়ের স্ত্রীকে নিয়ে বরগুনায় থাকেন। ছোট্ট দোকান চালান। এতে যে আয় হয়, তা দিয়েই স্বাচ্ছন্দ্যে চলে যায় তাঁর সংসার।

যাঁরা চেনেন, তাঁরা আবুল খায়েরের দোকান ছাড়া অন্য কোথাও কাজ করাতে যান না
ছবি: প্রথম আলো

কথা চলছিল, এমন মুহূর্তে এক ব্যক্তি একটি মোটর নিয়ে এসেছেন মেরামতের জন্য। আবু বকর নামের সদরের লাঙ্গলকাটা গ্রামের ওই ব্যক্তি এসেই বললেন, ‘খায়ের ভাই, মোটরটায় ডিফিট (ডিফেক্ট) দেছে, হারন লাগবে। আইজগোই কিন্তু দেওন লাগবে।’ খায়ের কাটখোট্টা স্বভাবের। মুখের ওপর তিনি বললেন, ‘হইবে না, অন্য জায়গায় দেহান।’ আবু বকর নাছোড়বান্দা। বললেন, ‘আপনেরে ছাড়া কিছুতেই হারামু (সাড়ানো) না, হ্যাতে পনেরো দিন লাগলেও।’ খায়ের এবার মুচকি হেসে বললেন, ‘বন (বসেন), এইবার কন, কী সমস্যা।’

কেন এমন কর্কশ কথা শুনেও এখানেই মোটর সারাবেন—এমন প্রশ্ন করলে আবু বকর বলেন, ‘উনি এ রকমই ব্যবহার করেন। কিন্তু কাজে কোনো ভ্যাজাল নাই। সময় নিয়া মেরামত করেন, তবে মজুরি নিয়া জোরজবরদস্তি করেন না। এই জন্য ওনারে যাঁরা চেনেন, হ্যারা এইহানেই আয়েন।’

২৪ বছর ধরে এই শহরে কাজ করছেন খায়ের। এখন বয়স ৫০। যৌবনের সেরা সময়গুলো তিনি এখানে কাটিয়ে দিয়েছেন। দক্ষিণের সাগরপারের এই আলো-বাতাসে বেড়ে উঠেছেন, মিশে গেছেন। বলেন, এই শহরটা মায়ার শহর। মানুষের মন নদীর মতো। তাই সেই মায়ায় এখানেই থেকে গেছেন। মৃত্যুর পরও এখানের মাটিতে মিশে থাকতে চান।

আবার সাইনবোর্ডের লেখার প্রসঙ্গ তুলতেই খায়ের বলেন, ‘আগে কাজ করাতে এসে নানা ঝামেলা হতো। অনেক কথা বলতে হতো। নিজের প্রশংসা করা আমার কাছে একেবারেই অরুচিকর। সবাই তো নিজের ঢোল পিটিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করেন। আমি কথায় নয়, কাজে বিশ্বাস করি। তাই একদিন ভাবলাম, এমন একটা সাইনবোর্ড লিখে ঝুলিয়ে দেব দোকানের সামনে, দেখি এতে কাস্টমার কমে কি না। সাহস করে কয়েক বছর আগে সাইনবোর্ডটা লেখালাম, লাগিয়ে দিলাম, ব্যস। প্রথম প্রথম সবাই হাসাহাসি করত। কেউ পাগল বলত। এখন কেউ করে না।’

২৫ বছর আগে ভোলা থেকে বরগুনা শহরে এসে বসবাস শুরু করেন আবুল খায়ের
ছবি: প্রথম আলো

হাতের কাজ থামিয়ে খায়ের বললেন, ‘আমাকে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা ঠিকই আমার কাছে আসেন। আরও বেশি বিশ্বাস করেন। আসলে জীবনকে আমরা যত সহজ করে ভাবব, জীবন আপনার কাছে তত সহজ হয়ে উঠবে। এতে চমৎকার একটা জীবন আপনি উপভোগ করতে পারবেন। এটা নির্ভর করে সম্পূর্ণই আপনার ইচ্ছার ওপর।’

খায়েরের জীবনবোধ সত্যি মুগ্ধ করার মতো। এই মুগ্ধতা নিয়ে ফেরার পথে কানে বাজছিল খায়েরের কথাগুলো।