‘আমার স্বামীও গেল, সন্তানডাও গেল, কারে আগলে বাঁচব’

স্বামী আর ছেলেকে হারিয়ে আর্তনাদ থামছে না স্বপ্না দেবনাথের
ছবি: প্রথম আলো

মহাদেব দেবনাথের মা লক্ষ্মী রানী দেবনাথ বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সড়ক দুর্ঘটনায় ছেলে ও নাতির মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে তিনি অসুস্থ হয়ে প্রায় শয্যাশায়ী। অপর দিকে স্বামী ও একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে স্বপ্না দেবনাথ আহাজারি করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। তাঁদের আর স্বজনদের মাতমে ভারী হয়ে উঠেছে বাড়ির পরিবেশ।

বুধবার দুপুরে মাদারীপুর সদর উপজেলার খোঁয়াজপুর ইউনিয়নের টেকেরহাট পালপাড়া এলাকায় দেবনাথ বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল এমন দৃশ্য। আইনি জটিলতা ও ময়নাতদন্ত শেষে বুধবার বিকেলে বাড়ির ঠিক সামনেই বাবা-ছেলের শেষকৃত্য একসঙ্গে সম্পন্ন হয়।

মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মাদারীপুর-শরীয়তপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের মঠেরবাজার এলাকায় একটি কার্গোর (বড় ট্রাক) ধাক্কায় অটোরিকশা থেকে পড়ে গিয়ে চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন স্বর্ণ ব্যবসায়ী মহাদেব দেবনাথ (৬০) ও তাঁর ছেলে মিঠুন দেবনাথ (১৪)। মিঠুন খোঁয়াজপুর টেকেরহাট উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল।

বুধবার দুপুরে মহাদেব দেবনাথের বাড়ির সামনে যেতেই দূর থেকে ভেসে আসে কান্নার আওয়াজ। কাছে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িভর্তি লোকজন। একমাত্র ছেলে আর স্বামীকে হারিয়ে পাগলপ্রায় স্বপ্না দেবনাথ। বারবার তিনি চিৎকার করে কান্নাকাটি করছেন। প্রতিবেশীরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। স্বপ্না দেবনাথ বলেন, ‘আমার স্বামীও গেল, সন্তানডাও গেল। আমি কারে আগলে বাঁচব? এই কষ্ট আমি ক্যামনে সহ্য করব? ওই ট্রাক আমার সব শ্যাষ কইরা দিয়া গেল। হায় ভগবান, তুমি আমার স্বামী–সন্তানডারে ফিরাইয়া দাও। নয়তো আমারেও তুমি নিয়া যাও।’

স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাদেব-স্বপ্না দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। বছরখানেক আগে মেয়ে রিচি দেবনাথের বিয়ে হয়েছে। বাবা ও ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে রাতেই তিনি ছুটে আসের বাবার বাড়িতে। রিচি বলেন, ‘আমার ছোট ভাইকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। ও অনেক ভাল ছাত্র ছিল। বিজ্ঞান নিয়ে পড়ত। তাই মা–বাবার স্বপ্ন ছিল ভাই চিকিৎসক হবে। কিন্তু সব স্বপ্ন শেষ হইয়া গেল।’

বাবা ও ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে আসেন রিচি দেবনাথ।
ছবি: প্রথম আলো

মিঠুনের মামা লিটন দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাগনে আমাকে ফোন করে বলেছিল, মামা নভেম্বরে পরীক্ষা শেষ হলে তুমি আমাদের বেড়াতে নিয়ে যেও। আজ চোখের সামনে ভাগ্নের লাশ দাহ হচ্ছে। যে ট্রাকচালক এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করছি।’

প্রতিবেশী দিপক কুমার পাল বলেন, এই পরিবারে একমাত্র উপর্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন মহাদেব। পরিবারটির নিজের বলে আর কেউ রইল না। তাঁদের সংসার কীভাবে চলবে, তা কারও জানা নেই। দুর্ঘটনায় একসঙ্গে বাবা-ছেলের এমন মৃত্যুতে এলাকার লোকজন শোকাহত।

এদিকে এ দুর্ঘটনায় গতকাল দুপুর ১২টার দিকে সদর মডেল থানায় একটি মামলা হয়েছে। এতে কার্গোর চালক মো. শাহাদাত খানকে (৩৪) আসামি করা হয়। মামলার পর চালককে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে পুলিশ। পরে আদালত চালককে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন এবং কার্গোটি পুলিশের জিম্মায় জব্দ রাখার নির্দেশনা দেন।

আরও পড়ুন

সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এইচ এম সালাউদ্দিন বলেন, নিহত মহাদেব দেবনাথের স্ত্রী স্বপ্না রানী বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। চালককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

স্থানীয় লোকজন বলেন, মঙ্গলবার দুপুরে ছেলে মিঠুনকে নিয়ে বাবা মহাদেব দেবনাথ মাদারীপুর শহরের বাদামতলা এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে যান। অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যায় একটি অটোরিকশায় করে তাঁরা নিজেদের বাড়ি টেকেরহাট পালপাড়ায় ফিরছিলেন। অটোরিকশাটি মঠেরবাজার এলাকায় এলে শরীয়তপুর থেকে আসা একটি কার্গো সামনে থেকে ধাক্কা দেয়। এ সময় অটোরিকশা থেকে বাবা ও ছেলে ছিটকে মহাসড়কে পড়ে ওই কার্গোর চাকায় পিষ্ট হন। এতে ঘটনাস্থলেই তাঁরা নিহত হন। এ সময় অটোরিকশার চালক গুরুতর আহত হলে তাঁকে স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে মাদারীপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতালে ভর্তি করেন।