শহরের কাছেই পাহাড়–ঝরনা ও সাগর–হ্রদ, ঘুরে আসুন এক দিনে

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সহস্রধারা ঝরনা। সম্প্রতি তোলাছবি: প্রথম আলো

পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঝরনার পানি। পাশেই আঁকাবাঁকা হ্রদ। একটু দূরে সমুদ্রসৈকত ঘেঁষে ছোটাছুটি করছে নৌকা। এমন সব দৃশ্যের দেখা মেলে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। পাহাড়–ঝরনা ও সাগর–হ্রদ সবকিছুই রয়েছে এই উপজেলায়। ফলে সীতাকুণ্ডে ভ্রমণে এসে খুব অল্প সময়েই মুগ্ধ হন পর্যটকেরা।

সীতাকুণ্ডে বেড়ানোর উপযুক্ত সময় বর্ষা থেকে শীত মৌসুম। বর্ষায় পানিতে টইটম্বুর থাকে ঝরনা। তবে এ সময় ভ্রমণ কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই শীত মৌসুমকেই নিরাপদ ভ্রমণ ও ট্রেকিংয়ের উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেন পর্যটকেরা। শীতল আবহাওয়ার কারণে এ সময় পাহাড়, জঙ্গল ও বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে ক্লান্তি লাগে না। সহজেই পাহাড়ে বেয়ে ওপরে ওঠা যায়।

সীতাকুণ্ডের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক। মহাসড়কের পূর্ব পাশে সারি সারি পাহাড়। আর সেখানেই রয়েছে ঝরনা ও হ্রদ। পাহাড়গুলোয় হনুমান–বানরসহ বন্য প্রাণীর ছোটাছুটি, ঝিঁঝি পোকার ডাক ও পাখির কলতান উপভোগ করা যায়। আর পশ্চিম দিকে সমুদ্রসৈকত। সেখানে বসে উপভোগ করা যায় লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি, সাগরের গর্জন ও মাছ ধরার নৌকাসহ মনোরম নানা দৃশ্য।

সীতাকুণ্ড উপজেলাটি চট্টগ্রাম নগরের পাশেই। ফলে চট্টগ্রাম নগর থেকে মাত্র এক দিনেই সীতাকুণ্ডের পাহাড়–ঝরনা ও সাগর–হ্রদের দৃশ্য উপভোগের সুযোগ রয়েছে। তবে সময় থাকলে দুই থেকে তিন দিনের ভ্রমণের পরিকল্পনাও নিতে পারেন। একটু আগেভাগে কোথায়, কীভাবে যাবেন—এসব ঠিক করে রাখলে ভ্রমণ যেমন আনন্দদায়ক হবে, তেমনি খরচও কম হবে।

সীতাকুণ্ডে ভ্রমণের ক্ষেত্রে পাহাড় ট্রেকিং ও ঝরনা–হ্রদ সকালে ঘুরে দেখাই ভালো। তাহলে বিকেলে সমুদ্রসৈকতে ঘুরে বেড়ানো যায়। সাগরপাড়ে বসে দেখা যায় সূর্যাস্তের দৃশ্য।

সীতাকুণ্ডে মোট আটটি ঝরনা রয়েছে। ঝরনাগুলো হলো সহস্রধারা–১, রূপসী ঝরনা, সুপ্তধারা, সহস্রধারা–২, মধুখাইয়া, বাড়বকুণ্ডের অগ্নিকুণ্ড, বাঁশবাড়িয়া বিলাসী ঝরনা ও কুমারীকুণ্ড। এর মধ্যে সহজেই সহস্রধারা–২ ঝরনাটিতে যেতে পারেন পর্যটকেরা। কিন্তু অন্য সাতটি ঝরনায় যেতে হলে পর্যটকদের পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে হয়।

সীতাকুণ্ডে মোট আটটি ঝরনা রয়েছে। ঝরনাগুলো হলো সহস্রধারা–১, রূপসী ঝরনা, সুপ্তধারা, সহস্রধারা–২, মধুখাইয়া, বাড়বকুণ্ডের অগ্নিকুণ্ড, বাঁশবাড়িয়া বিলাসী ঝরনা ও কুমারীকুণ্ড। এর মধ্যে সহজেই সহস্রধারা–২ ঝরনাটিতে যেতে পারেন পর্যটকেরা। কিন্তু অন্য সাতটি ঝরনায় যেতে হলে পর্যটকদের পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে হয়। পাহাড় ডিঙিয়ে ঝরনার কাছে যাওয়ার রোমাঞ্চকর যাত্রা পর্যটকেরা বেশ উপভোগ করেন। সীতাকুণ্ডে ঘুরে বেড়ানোর মতো তিনটি সমুদ্রসৈকত রয়েছে। এর মধ্যে আকিলপুর ও বাঁশবাড়িয়া সমুদ্রসৈকত বালুময়। এর বাইরে গুলিয়াখালী সৈকতটি ম্যানগ্রোভ বনযুক্ত।

কম পরিশ্রমে ঝরনা, হ্রদ ও সমুদ্রসৈকত দেখতে এক দিনের ভ্রমণের পরিকল্পনায় রাখতে পারেন সহস্রধারা ঝরনা–২ ও লবণাক্ষ হ্রদ ও গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকত। তবে কিছুটা পরিশ্রম করলে এর সঙ্গে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের সুপ্তধারা ঝরনা ও সহস্রধারা ঝরনা–১ ঘুরে আসা যায়। সীতাকুণ্ডে পর্যটকদের জন্য কিছুটা কষ্টকর যাত্রা হয় চন্দ্রনাথ পাহাড় ও মন্দির, রূপসী ঝরনা ও বিলাসী ঝরনায় যাওয়ার ক্ষেত্রে। তবে সুবিধা হলো সীতাকুণ্ডের সব পর্যটন স্পটই মাত্র ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে।

পানির ওপরে আগুন জ্বলছে। সীতাকুণ্ডের অগ্নিকুণ্ড মন্দিরে এই দৃশ্য আর অগ্নিকুণ্ড ঝরনা দেখতে প্রায়ই আসেন পর্যটকেরা। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

সীতাকুণ্ডে যাওয়া ও থাকা

ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম থেকে যেকোনো বাসযোগে সীতাকুণ্ড পৌর সদরের বাসস্ট্যান্ডে নামতে হবে। চট্টগ্রাম নগর থেকে যেতে খুব একটা সময় লাগে না। তাই দূরের পর্যটকেরা চট্টগ্রাম নগরে রাতযাপন করে সীতাকুণ্ডে ঘুরে বেড়াতে পারেন। তবে সীতাকুণ্ডেও বিভিন্ন মানের ১৯টি হোটেল রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে ১০টি হোমস্টে। ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যেই কক্ষ ভাড়া পাওয়া যায়।

ভ্রমণ পরিকল্পনা–১

ঝামেলা এড়িয়ে কম পরিশ্রমে এক দিনের পরিকল্পনায় রাখতে পারেন সহস্রধারা ঝরনা–২, লবণাক্ষ হ্রদ ও গুলিয়াখালী সৈকতে ঘুরে বেড়ানো। লবণাক্ষ হ্রদ ও সহস্রধারা ঝরনা–২ যেতে সীতাকুণ্ড পৌর সদর থেকে মিনিবাস কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ছোট দারোগাহাট নামতে হবে। এরপর হেঁটে কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় সূর্য মন্দির যেতে হবে। তারপর টিকিট কেটে লবণাক্ষ হ্রদে বেড়াতে পারেন। নৌকায় ভ্রমণ করতে করতে একসময় পৌঁছে যাবেন সহস্রধারা ঝরনা–২–এ। সেখানে ঝরনার পানিতে নিজেকে ভিজিয়ে নিতে পারেন। তবে হ্রদের পানিতে না নামায় উত্তম। কারণ, হ্রদটি অত্যন্ত গভীর এবং পানিও ঠান্ডা। এই ঝরনা দেখার যাত্রা সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে করাই ভালো। এরও আগে যেতে পারেন। যেতে সময় লাগতে পারে আধা ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা। তবে যেভাবেই যান না কেন, ফিরতে হবে বেলা দেড়টার মধ্যে।

সীতাকুণ্ডে যদি হোটেল ভাড়া নেন, তবে এর আশপাশে দুপুরের খাবার সেরে হালকা বিশ্রাম নিলে ক্লান্তি কম হয়। বিশ্রাম শেষে পৌর সদরের নামার বাজার সড়কের মাথায় গিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় গুলিয়াখালী সৈকতের উদ্দেশে রওনা দিতে হবে। বেলা সাড়ে তিনটার মধ্যে গুলিয়াখালী বেড়িবাঁধে পৌঁছাতে পারলে সুবিধা হয়। এরপর হেঁটে কিংবা নৌকায় মূল সৈকতে যাওয়া যায়। সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেখানে কাটিয়ে ভ্রমণ শেষ করতে পারেন।

ভ্রমণ পরিকল্পনা–২

পাহাড় ট্রেকিং, দুটি ঝরনা ও সমুদ্রসৈকত দেখতে এ পরিকল্পনাটি করতে পারেন। এটিতে রয়েছে বোটানিক্যাল গার্ডেন, সুপ্তধারা ঝরনা ও বাঁশবাড়িয়া সৈকতে ঘুরে বেড়ানো। এটিও শুরু করার উত্তম সময় সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে।
সীতাকুণ্ড পৌর সদরের মন্দির সড়কের মাথা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যেতে হবে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের ফটক। এরপর টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করলেই পাহাড় ট্রেকিং শুরু। কিছুদূর গেলে দেখা মিলবে সুপ্তধারা ঝরনার। এরপর সেখান থেকে পাহাড় বেয়ে আরও এক হাজার ফুট ওপরে উঠলে দেখা মিলবে সহস্রধারা ঝরনা–১। সেখান থেকে বেলা আড়াইটার মধ্যে ফিরতে হবে। এরপর হালকা বিশ্রাম শেষে রওনা দিতে হবে বাঁশবাড়িয়া সৈকতের উদ্দেশে। ইকোপার্কের গেট থেকে কিংবা সীতাকুণ্ড বাসস্ট্যান্ড থেকে ৮ ও ১৭ নম্বর মিনিবাসে বাঁশবাড়িয়া বাজারে নামতে হবে। এরপর মহাসড়ক পার হয়ে সৈকত সড়কের মাথা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাওয়া যায় সমুদ্রসৈকতে। বিকল্প হিসেবে পৌর সদরের কলেজ রোডের মাথা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে বাঁশবাড়িয়া সৈকতে যাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া দরদাম করে নিতে হবে।

সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া সমুদ্রসৈকত। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ভ্রমণ পরিকল্পনা–৩

ভূমি থেকে ১ হাজার ২০০ ফুট ওপরে পাহাড়ের চূড়ায় থাকা চন্দ্রনাথ মন্দির ও সমুদ্রসৈকত ভ্রমণে এ পরিকল্পনাটি নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ভ্রমণ সকাল সাতটা থেকে আটটার মধ্যে শুরু করতে পারলে ভালো হয়। পাহাড় বেয়ে ওঠানামায় চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় লেগে যেতে পারে।

শুরুতেই পৌর সদরের মন্দির সড়কের মাথা থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে ৩ নম্বর সেতু পর্যন্ত যেতে হবে। পথে অসংখ্য মঠ ও মন্দির দেখা যাবে। এরপর হেঁটে পাহাড়ে ওঠার পালা। পাহাড়টির একেবারে চূড়ায় রয়েছে চন্দ্রনাথ মন্দির। দ্বিতীয় বৃহত্তম চূড়ায় বিরূপাক্ষ মন্দির। চূড়ায় ওঠার সময় পথে পথে বানরের দেখা মিলতে পারে। শোনা যাবে পাখিদের কিচিরমিচির। বিরূপাক্ষ মন্দিরের কাছাকাছি গেলে মেঘের ছোঁয়াও পাওয়া যেতে পারে। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পর ক্লান্ত–পরিশ্রান্ত শরীরে চারদিকে সবুজ পাহাড় দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যাবে। এরপর ফিরে এসে আকিলপুর সৈকতে বেড়াতে পারেন। সে ক্ষেত্রে পৌর সদর থেকে ৮ ও ১৭ নম্বর মিনিবাসে ছোট কুমিরা বাজারে নামতে হবে। সেখান থেকে অটোরিকশায় সমুদ্রসৈকতে যাওয়া যায়।

ভ্রমণ পরিকল্পনা–৪

সূর্যাস্ত দেখা ও নৌকায় ভ্রমণের জন্য যেতে পারেন ভাটিয়ারী লেক ও সানসেট পয়েন্ট। এ দুটি পর্যটনকেন্দ্র সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত। চট্টগ্রাম নগর থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে ভাটিয়ারী বাজার। সীতাকুণ্ড থেকে এর দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় শুরুতেই আপনি যেতে পারেন ভাটিয়ারী হ্রদে। এই যাত্রা দুপুরে শুরু করলেও পারবেন। সেখানে কিছুক্ষণ নৌকায় ভ্রমণ করে সেনাবাহিনী পরিচালিত সানসেট রেস্তোরাঁয় সময় কাটানো যায়। রেস্তোরাঁটি পাহাড়ের টিলায়। সেখান থেকেও সুন্দর সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়। একই দিনে আপনি চাইলে সকালে কিংবা বিকেলে কুমিরা জেটি ঘুরে আসতে পারেন। ৭০০ মিটারের জেটিতে দাঁড়িয়ে সাগরের দৃশ্য দেখে মনোরম বিকেল কাটানো যায়। এ ছাড়া সেখান থেকে দেখা যায় জাহাজভাঙার কাজ। উপকূলের কিছু কারখানায় পুরোনো জাহাজ কাটা হয়।

পাহাড় ঘেরা লবণাক্ষ হ্রদ। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ভ্রমণ পরিকল্পনা–৫

সীতাকুণ্ড ভ্রমণে অগ্নিকুণ্ড মন্দির, অগ্নিকুণ্ড ঝরনা ও সৈকত ভ্রমণও রাখতে পারেন পরিকল্পনায়। এর জন্য ভ্রমণ শুরু করতে হবে সকালে। সীতাকুণ্ড সদর কিংবা চট্টগ্রাম নগর থেকে বাসযোগে বাড়বকুণ্ড বাজারে পৌঁছাতে হবে। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা ব্যাটারিচালিত রিকশায় যাওয়া যাবে অগ্নিকুণ্ড মন্দিরের একেবারে কাছে। এরপর ছোট্ট একটি পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠলে অগ্নিকুণ্ড মন্দির। সেখানে দেখা যাবে পানির ওপরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। মন্দিরের কাছেই অগ্নিকুণ্ড ঝরনা। তবে শীতকালে এই ঝরনায় পানি থাকে না। অগ্নিকুণ্ড মন্দির থেকে ফিরে এসে বিকেলে যেকোনো একটি সমুদ্রসৈকতে ভ্রমণের মতো পর্যাপ্ত সময় থাকে।

পাশেই মিরসরাই

সীতাকুণ্ডের মতো ঝরনা–হ্রদ রয়েছে পাশের উপজেলা মিরসরাইয়েও। সেখানে মুহুরী প্রজেক্ট, মহামায়া হ্রদ, খৈয়াছাড়া ঝরনা, রূপসী ঝরনা, ডোমখালী সমুদ্রসৈকত, মেলখুম ট্রেইলসহ বেশ কিছু পর্যটন স্পট রয়েছে। সীতাকুণ্ডের সঙ্গে চাইলে পাশের উপজেলা মিরসরাইয়ের এসব পর্যটনকেন্দ্রও ভ্রমণের পরিকল্পনায় রাখা যায়।