নড়াইলে নির্বাচন করতে চেয়ে এক সচিবের সভা, কী বলছে চাকরিবিধি

ঈদের ছুটিতে নড়াইলে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কয়েকটি পথসভা ও মতবিনিময় সভা করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব খাজা মিয়া। ৩০ জুন নড়াইলের কালিয়া উপজেলার মহাজন বাজারের বেবিস্ট্যান্ডের পথসভায়
ছবি: প্রথম আলো

পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কয়েকটি পথসভা ও মতবিনিময় সভা করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব খাজা মিয়া। এসব সভায় তিনি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নড়াইল-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য কবিরুল হকের (মুক্তি) বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর এ ধরনের কর্মকাণ্ড সরকারি চাকরিবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

জ্যেষ্ঠ সচিব খাজা মিয়ার বাড়ি নড়াইলের কালিয়া উপজেলার ফুলদাহ গ্রামে। ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ঈদের পরে ৩০ জুন ও ১ জুলাই এলাকায় কয়েকটি পথসভা ও মতবিনিময় সভা করেন তিনি। গত ৩০ জুন সকালে তিনি কালিয়ার মাউলী ইউনিয়নের মহাজন বাজারের বেবিস্ট্যান্ড, দুপুরে খাশিয়াল ইউনিয়নের খাশিয়াল ও পুঁটিমারী বাজারে, বিকেলে বাঐসোনা ইউনিয়নের জোগানিয়া বাজার ও পহরডাঙ্গা ইউনিয়নের পাখিমারা বাজারে এবং সন্ধ্যায় কলাবাড়িয়া ইউনিয়নের কলাবাড়িয়া পূর্বপাড় বাজারে পথসভা করেন। পরের দিন তিনি সদর উপজেলার সিঙ্গাশোলপুর ইউনিয়নের গোবরা বাসস্ট্যান্ড, বিছালী ইউনিয়নের চাকই মোড় এবং কলোড়া ইউনিয়নের বাহিরগ্রামে পথসভা ও মতবিনিময় সভা করেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, খাজা মিয়া একটি পথসভায় বক্তব্য দিচ্ছেন। ভিডিওটি ১ জুলাই নড়াইল সদর উপজেলার গোবরা বাসস্ট্যান্ডের পথসভার। সেখানে তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজকে বাংলাদেশে উন্নয়নের যে জোয়ার বয়ে চলেছে, সেই জোয়ারের ধারাবাহিকতায় ডিজিটাল বাংলাদেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশে উন্নীত হতে চলেছি। কিন্তু বাস্তবে কী আমরা পাচ্ছি আমাদের নড়াইল-১ আসনের জন্য? নড়াইল-১ আসনে আমি কিন্তু কোনো উন্নয়নের জোয়ার দেখি না। আমার বরং মনে হয়, এখানে উন্নয়নের ভাটা লেগেছে। আমি গত দুই দিন যেসব অঞ্চলে গিয়েছি, প্রত্যেকটা জায়গায় একটি-দুটি জায়গা ছাড়া অধিকাংশ রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ।’

এটা সরকারি চাকরি বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ফৌজদারি অপরাধ। সরকারি চাকরির সর্বোচ্চ পদ সচিব। সেই সচিবের চেয়ারে বসে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এটা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল।
কবিরুল হক, সংসদ সদস্য, নড়াইল-১

নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্য কবিরুল হকের সমালোচনা করে খাজা মিয়া বলেন, ‘আশা করেছিলাম তিনি (সংসদ সদস্য) একলাস উদ্দিন সাহেবের সুপুত্র, তিনি এলাকার উন্নয়নের জন্য কাজ করবেন। আমি এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া দেখতে পাইনি। বরং আমি উল্টো কিছু শুনেছি। সেটা কী? প্রতিটি প্রাইমারি স্কুলে অবৈধ নিয়োগ–বাণিজ্যের মাধ্যমে কতিপয় ব্যক্তি, তাঁর নেতৃত্বে কি না আমি সেটা আমি বলব না, কিন্তু কতিপয় ব্যক্তি অবৈধ নিয়োগপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছে। নড়াইল-১ আসনের ২০টি ইউনিয়নের প্রতিটি বিদ্যালয়ে এই অযোগ্য লোকদের নিয়োগ করে, স্থানীয় লোক বাদ দিয়ে নিজের পছন্দমতো ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি গঠন করে তাদের মাধ্যমে এই অবৈধ অর্থের মালিক হয়ে আজকে অনেকে ঢাকা, খুলনায় বাড়ি করেছেন। এই নড়াইলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন না করে তিনি নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন।’

আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব খাজা মিয়া বলেন, ‘আপনাদের মাধ্যমে নড়াইল-১ আসনের সব জনগণের কাছে একটা কথা পৌঁছে দিতে চাই। আমি আমার চাকরিজীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি। আমি শেষ প্রান্তে পৌঁছে প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, আমার মাত্র আর কয়েক মাস চাকরি আছে। আমি আর চাকরি করব না। আপনি আমাকে নমিনেশন দেন। আমি কালিয়ায় ফিরে যেতে চাই। এই কালিয়ায় আমার জন্ম, আমি এখানেই বেড়ে উঠেছি, এখানেই আমি গড়ে উঠেছি। এখানে আমি ছাত্ররাজনীতি করেছি। উনি বলেছেন, তোমাদের একটি মামলা আছে, তোমাদের একটি আইনি বার (বাধা) আছে, তিন বছরের আগে নির্বাচন করতে পারবে না। আমি বলেছি, নেত্রী, আমরা ওই তিন বছরের আইনি বার তুলে দিতে হাইকোর্টে মামলা করেছি। মামলার রায় হয়তো আমাদের পক্ষে আসবে। রায় পেলে আমি নেত্রীর কাছে গিয়ে বলব যে আমি এলাকার মানুষের কাছে ফিরে যেতে চাই। যদি আমাকে নমিনেশন দেন আমি মানুষের কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে চাই।’

জ্যেষ্ঠ সচিব খাজা মিয়ার এ ধরনের কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্য কবিরুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি চাকরিজীবীদের একটি চাকরি বিধিমালা আছে। সেই বিধিমালাকে পাশ কাটিয়ে সচিব সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। আমার বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করেছেন। এটা সরকারি চাকরি বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ফৌজদারি অপরাধ। সরকারি চাকরির সর্বোচ্চ পদ সচিব। সেই সচিবের চেয়ারে বসে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এটা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল।’ বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন বলে দাবি করেন।

আইন কী বলছে

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর বিধি ২৫-এ বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে বা কোনোভাবে যুক্ত হতে পারবেন না অথবা বাংলাদেশ বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বা কোনো প্রকারেই সহযোগিতা করতে পারবেন না।’

অন্যদিকে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ১২ (১) (চ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হইবার, বা থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি তিনি প্রজাতন্ত্রের বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের বা প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগের কোনো চাকরি হইতে পদত্যাগ করিয়াছেন বা অবসরে গমন করিয়াছেন এবং তাহার পদত্যাগ বা অবসরে গমনের পর তিন বছর অতিবাহিত না হয়।’

জ্যেষ্ঠ সচিব খাজা মিয়ার চাকরির এখনো এক বছর আছে। ২০২৪ সালের ৪ জুলাই তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ হবে।