‘বাপের কাছে গেলে হতাই মা মারে, মার কাছে গেলে হতাই বাপ’

যাত্রীদের ডাকা থেকে শুরু করে ভাড়া আদায়, সবই করতে হয় মেরাজুলকে
ছবি: প্রথম আলো

শরতের নীল আসমানে সফেদ মেঘ। মিনিবাসের চিটচিটে সিটে বসে জানালা দিয়ে মেঘের আনাগোনা দেখি। বাঘের তাড়া খাওয়া হরিণের দলের মতো মেঘেরা মুহূর্তেই চোখের আড়াল হয়। দৃষ্টি সরতেই চোখ আটকায় বাসের দরজায়। ১২ কি ১৩ বছরের কিশোর দরজায় দাঁড়ানো। ঘন কালো চুল, মায়াবী চোখ। বাইরে মুখ বের করে আনমনে হাসছে।

‘কিরে, কই গেলি?’ বাসচালকের এমন চিৎকারে কিশোর চমকে ওঠে। বাসের ভেতরে এসে দাঁড়ায়। নীল রঙের ইউনিফর্ম গায়ে জড়ানো। হাড়জিরজিরে শরীর। হাতে কালো ঘড়ি। ময়লা–জীর্ণ থ্রি–কোয়ার্টার প্যান্ট। পায়ে বেখাপ্পা জুতা। বিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী ভেবে মুহূর্তের জন্য ভুল হয়। ভুল ভাঙে কিশোরের বাঁ হাতের আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে ৫, ১০ টাকার গোছানো নোট দেখে।

যাত্রীদের ভাড়ার জন্য তাড়া দেয় কিশোর। ২০ টাকার নোট দিয়ে ১৫ টাকা ফেরত চান এক যাত্রী। যাত্রীর সামনে ১০ টাকার নোট এগিয়ে ধরতেই খেপে ওঠেন তিনি। বলেন, ‘ওই বেটা, তেলের দাম কমছে না, ভাড়া বেশি রাখস কেন?’ কিশোরও কম যায় না, ‘লিটারে দাম কমছে পাঁচ টেহা, আপনের ভাড়া দশ টেহা। কয় টেহা কমামু?’ এভাবেই যাত্রীদের সঙ্গে চিৎকার-চেঁচামেচি করে ভাড়া আদায় চলে। কেউ কেউ বাড়তি ভাড়ার জন্য গালাগাল দেয়, রাগ ঝাড়ে। এক স্টপেজ থেকে আরেক স্টপেজে বাস থামে। হাঁকডাক চলে কিশোরের, ‘এই রূপসী গাউছিয়া, রূপসী গাউছিয়া।’ একসময় বাস গিয়ে থামে নারায়ণগঞ্জের ভুলতা বাসস্ট্যান্ডে। সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে আসা বাসটির এখানেই শেষ গন্তব্য।

সব যাত্রী নেমে গেলে কিশোরের পাশে গিয়ে বসি। নাম জানতে চাইলে নাম বলে মো. মেরাজুল হাসান। বাবা কী করেন জানতে চাইলে বলে, ‘বাপ-মা থাইকাও নাই। বাপে আরেক বিয়া কইরা চইলা গেছে। পরে মায়ও বিয়া করছে।’

মেরাজুলের ভাষ্য, তার জন্ম সিদ্ধিরগঞ্জের বাগানবাড়ি এলাকায়। আবদুর রহমান আর চম্পা বেগমের সংসারে মেরাজুল বড়। বাবা দিনমজুর। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। মেরাজুলের ইচ্ছা হয় পড়াশোনা করার। সিদ্ধিরগঞ্জ আরবান স্লাম আনন্দ স্কুল নামের একটি অবৈতনিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু হয়। সেখানেই দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া। একদিন বিদ্যালয় থেকে ফিরে মেরাজুল জানতে পারে, তার বাবা বিয়ে করেছেন। তা নিয়ে মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া। সেই ঝগড়া থেকে স্বামীর সংসার ছাড়েন চম্পা। মায়ের সঙ্গ নেয় মেরাজুল ও তার ছোট বোন স্মৃতি। কেবল মা-বাবার সম্পর্ক নয়, তখন থেকে বিদ্যালয়ের সঙ্গেও মেরাজুলের বিচ্ছেদ ঘটে।

অন্যের বাসায় কাজ করে তিনজনের সংসার চলে না। অন্য কোনো উপায় না পেয়ে ৯ বছর বয়সী ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দেন চম্পা। শিক্ষার্থী মেরাজুলের পরিচয় পাল্টে হয়ে যায় লেগুনাচালকের সহকারী। এরপর কেটে গেছে তিন বছর। লেগুনায় যে আয় হতো, তা নিয়ে মায়ের কাছে ফিরত মেরাজুল। একদিন জানতে পারে, মায়ের অন্য জায়গায় বিয়ে হয়েছে।

প্রতিদিন আয় কেমন—জানতে চাইলে মেরাজুল বলে, ‘বাজার ভালা হইলে ৫০০ আবার কোনো দিন ১০০ থেকে ২০০, আবার কোনো দিন এক টেকাও না।’ কথার মানে না বুঝলে মেরাজুল বোঝানোর দায়িত্ব নেয়। বলে, ‘বাসের জমা দুই হাজার। তেলের খরচ, রাস্তার টোল। তিনজন মানুষের খাওনদাওন। এরপর যা থাকে, হেইডার অর্ধেক ওস্তাদের (চালক)। বাকি অর্ধেক আমাগো দুই হেলপারের।’

লেগুনার তুলনায় বাসের কাজ বেশি সহজ মনে হয় মেরাজুলের কাছে। জানতে চাইলে বিস্তর আলাপ জুড়ে দেয়। বলে, ‘লেগুনায় ঝুইলা থাকতে অয়। হাত ছুটলেই মরন। ধুলাবালু, রইদের উপরে বড় গাড়ি লাগায়া-টাগায়া দেয়। বাসে এইগুলা নাই। তয় এনে চিল্লাইতে চিল্লাইতে গলাব্যথা অইয়া যায়। আর বড় সমস্যা হইল মানুষের গালিগালাজ। মানসে লিগ্যাল ভাড়া দিতে চায় না। তেলের দাম বাড়ানোর পরে তো মাথাডাই নষ্ট। ভাড়া চাইলেই মানুষ বাপ-মা তুইলা গালি দেয়। আমরা গালি দিমু কারে, তেলের দাম কি আমরা বাড়াইছি?’

এখন কোথায় থাকা হয়—জানতে চাইলে মেরাজুল মাথা নিচু করে ক্ষীণ স্বরে উত্তর দেয়, ‘গাড়িতেই থাকি।’ বাড়ি যাও না—প্রশ্ন করলে মেরাজুলের চোখ ছলছল করে। বলে, ‘না। কই যামু? বাপের কাছে গেলে হতাই মা মারে আর মার কাছে গেলে হতাই বাপ। হোটেলে খাই। মাঝেমইধ্যে বইনরে দেখতে যাই। গত সপ্তায় গিয়া ওরে দেইখা আইছি। আমি গেলে ওয় খুশি অয়। পকেটে চল্লিশ টেহা আছিল, ওরে দিসি বিশ টেহা, আমার বিশ টেহা।’

কথায় কথায় বেলা গড়িয়ে দুপুর। মেরাজুলের ডাক পড়ে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মেরাজুল সকালের নাশতা খেতে যায়। যাওয়ার আগে জানতে চাই, সুযোগ পেলে পড়াশোনা করবে? মেরাজুল সরাসরি কোনো উত্তর দেয় না। বলেন, ‘ইশকুলের মেডামরা অনেক আদর করত। আমি পড়া পারতাম। ভাবছিলাম পড়ালেহা কইরা বড় অফিসার হমু।’