দুই বছর আগে এক ছেলে ও পাঁচ মেয়ের বাবা আবদুস সামাদ (৭২) মারা যান। এর এক বছর পর তাঁর একমাত্র ছেলে আবু হাসানও (৩২) মারা যান। হাসানের মৃত্যুর পর পৈতৃক সম্পত্তির ১৪ শতক ভিটা ও আবাদের ৫০ শতক জমি তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগম জাল দলিল করে নিজের নামে লিখে নেন। তিনি হাসানের মা মজিদা বেগমকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। বৃদ্ধ বয়সে মজিদা বেগম ও তাঁর পাঁচ মেয়ে সম্পত্তি হারিয়ে মহাবিপদে পড়ে যান।
এ অবস্থায় মজিদা বেগম শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিনের কাছে বিচার দাবি করেন। বিষয়টি শুনে চেয়ারম্যান ‘গ্রাম আদালত’–এর মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করে দেন। গ্রাম আদালতে বিচারের মাধ্যমে হাসানের মা, পাঁচ বোন ও স্ত্রীকে প্রাপ্ত অংশের জমি বুঝিয়ে দেন।
নালিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের সবার আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে এ গ্রাম আদালত। এক বছরে ইউপি চেয়ারম্যানের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইউপি সদস্যদের নিয়ে জুরিবোর্ডের মাধ্যমে গ্রাম আদালত পরিচালনা করা হয়। এক বছরে এ আদালতে ৩৮৭টি ঘটনা নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
গ্রামের লোকজন বলেন, তাঁরা দরিদ্র মানুষ। গ্রাম আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পেয়ে তাঁরা খুশি। পুলিশ, আদালতের চক্কর ও অর্থ অপচয় থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
গ্রাম আদালত কীভাবে পরিচালিত হয়, তা জানতে চাইলে আন্ধারুপাড়া গ্রামের মজিদা বেগমের ঘটনাটির কথা টেনে আনেন জনপ্রতিনিধিরা। তাঁরা বলেন, জমির ঘটনাটি নিষ্পত্তির জন্য মজিদা ও নাজমা দুই পক্ষের মনোনীত ব্যক্তি এবং ইউনিয়ন পরিষদের দুজন সদস্য দিয়ে চার সদস্যের জুরিবোর্ড গঠন করা হয়। নাজমা আদালতের কাছে বলেন, তাঁর স্বামী তাঁর নামে ৫৪ শতক সম্পত্তি লিখে দিয়ে গেছেন। তা শুনে নাজমার কাছে দলিল চাওয়া হয়। জুরিবোর্ড যাচাই-বাছাই করে দেখেন দলিলটি জাল। পরে নাজমা বিষয়টি মেনে নিয়ে চেয়ারম্যানের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেন।
নিজের গ্রামেই বিচার হয়। বাড়তি কোনো টাকাপয়সা লাগে না। যাতায়াতের কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না।মো. আসমত আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা
পরে জুরিবোর্ডের পরামর্শে ও রাষ্ট্রীয় নিয়ম অনুযায়ী মজিদাকে স্বামীর সম্পত্তির অংশ হিসেবে পুকুর ভরাট করে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া মজিদা ও তাঁর পাঁচ মেয়ে এবং নাজমাকে প্রাপ্ত অংশের জমি দলিল করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আসমত আলী বলেন, ‘অধিকাংশ বিচারের আমার থাকার সুযোগ হয়েছে। গ্রামের অসহায় ও দরিদ্র মানুষ বিচার চেয়ে সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার পেয়েছেন। নিজের গ্রামেই বিচার হয়। বাড়তি কোনো টাকাপয়সা লাগে না। যাতায়াতের কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। গ্রামের মানুষ বিচার চেয়ে ন্যায়বিচার পেয়েছেন।’
পোড়াগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, এ ইউনিয়নে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের বাস। অধিকাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। নিম্নবিত্ত মানুষের সংখ্যাই বেশি। ২০২১ সালে গোজাকুড়া দাখিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. জামাল উদ্দিন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গ্রাম আদালতকে সক্রিয় করতে গ্রামে গ্রামে প্রচারণা চালান।
প্রথম প্রথম গ্রাম আদালতের বিচার নিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করত। পরে ন্যায়বিচার পেয়ে মানুষের সন্দেহ কাটে। ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে গত এক বছরে পারিবারিক কলহ নিয়ে ১৫৪টি ঘটনা, জমিসংক্রান্ত বিরোধের ১৪২টি, মারামারিসংক্রান্ত ২৮টি ঘটনার নিষ্পত্তির হয়েছে এ গ্রাম আদালতে। এ ছাড়া আদালত ফেরত ৭টি ও অন্য বিষয়ের আরও ৫৬টি ঘটনা নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
ইউপি চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন বলেন, গ্রামীণ নারী, শিশু ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বিচার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে গ্রাম আদালত পরিচালিত হচ্ছে। গ্রাম আদালত অপরাধের কারণ অনুসন্ধান করে এর প্রতিকার করার চেষ্টা করে।
ইউএনও খৃষ্টফার হিমেল রিছিল বলেন, গ্রাম আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া ঘটনার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।