খলিফাপট্টি: হাল ফ্যাশনের অনুকরণে যেখানে পোশাক তৈরি হয়
ঈদকে ঘিরে একসময় নিত্যনতুন নকশা ও ডিজাইনের পোশাক তৈরি করতেন চট্টগ্রাম নগরের খলিফাপট্টির দরজিরা। সম্পূর্ণ নিজস্ব ভাবনায় তাঁরা তা করতেন। এখনো সেই ধারা অব্যাহত আছে। তবে এখন নিজেদের ডিজাইন বাদ দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানি পোশাকের অনুকরণে মূলত পোশাক তৈরি হচ্ছে খলিফাপট্টিতে। হালের ফ্যাশনের সঙ্গে তাল মেলানো এসব পোশাকের কদরও রয়েছে সবখানে।
প্রতিবারের মতো এবারও পবিত্র রমজানের দুই থেকে তিন মাস আগে খলিফাপট্টির ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। খলিফাপট্টির প্রায় ৩০০ দোকান আধুনিক ডিজাইনের পোশাক তৈরি করে মজুত বাড়িয়েছে, চলছে বিক্রিও। প্রতিবছর রোজার আগে থেকেই বিক্রয় উৎসব শুরু হয় খলিফাপট্টিতে। প্রথম ১৫ রোজার পর আরও জমজমাট হয় ব্যবসা।
দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে দরজিপাড়াটি গড়ে ওঠে নগরের ঘাটফরহাদবেগ–সংলগ্ন এলাকায়। তখনো পোশাক শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি চট্টগ্রামে। নোয়াখালী থেকে আসা এক–দুজন দরজির হাত ধরে খলিফাপট্টির গোড়াপত্তন শুরু হয়। এ কারণে খলিফাপট্টির প্রায় সব দোকানের মালিক নোয়াখালীর বাসিন্দা। বংশপরম্পরায় তাঁরা ব্যবসা করে চলেছেন।
শাহীনুর গার্মেন্টসের মালিক মো. সিরাজ মিয়া ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রামের খলিফাপট্টিতে আসেন। তিনি বলেন, এখানে সব দোকানের মালিক নোয়াখালীর। সবার দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্ম ব্যবসা করছে। কিন্তু তাঁর ছেলেরা এই ব্যবসায় আসেননি কেউ। প্রতি ঈদের মতো এবারও জমজমাট ব্যবসা চলছে বলে জানান তিনি।
ব্যবসায়ীরা জানান, স্যাটেলাইট টিভি, হিন্দি ছবি কিংবা ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার পর থেকে এখন সবাই বিদেশি ফ্যাশনে অভ্যস্ত। যার কারণে নায়ক-নায়িকাদের আদলে পোশাক তৈরি করতে হয়। এবার মেয়েদের ‘ফার্সি’ আর ‘গাউন’ নামের দুটি পোশাক খুব চলছে বলে জানান তাঁরা।
নুর কালেকশনে ঝুলছিল গাউন ও ফার্সি। গাউনটি মূলত লেহেঙ্গার মতো দেখতে। গায়ে জরি, চুমকিসহ নানা কারুকাজ। একইভাবে ফার্সি পোশাকটির ওপরের অংশেও ব্যাপক কারুকাজ। নিচের অংশটি পালাজ্জো পায়জামার মতো দেখতে। প্রায় সব দোকানে এই পোশাক দুটি প্রদর্শন করা হচ্ছে।
নুর কালেকশনের ওসমান ছিদ্দিক বলেন, এবার এই দুটি পোশাক খুব চলছে। বিক্রি হচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায়। পাশাপাশি অন্যান্য নতুন পোশাকও বিক্রি হচ্ছে। বিদেশি পোশাকের আদলে এগুলো তৈরি করা হয়। মূলত অনুকরণ করা হয় এখানে।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা এবং নগরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দোকানিরা ছুটে আসেন খলিফাপট্টিতে। ঈদকে সামনে রেখে সাহ্রির সময় পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। গতকাল বিকেলে এখানে দেখা হয় মাসুম নামের এক ক্রেতার সঙ্গে। তিনি বলেন, বন্দর এলাকায় তাঁর দোকান রয়েছে। প্রতিবার ঈদের সময় এখান থেকে পোশাক নিয়ে বিক্রি করে থাকেন। এবারও এসেছেন।
খলিফাপট্টিতে প্রতিটি দোকানের নিজস্ব কারখানা রয়েছে। কারও ৪টি, কারও ২০টি পর্যন্ত সেলাই মেশিন রয়েছে। এসব মেশিনে কাজ চলে সারা রাত। বিক্রিও চলে সাহ্রি পর্যন্ত। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তদের নাগালের উপযোগী এসব পোশাক চলে যায় আশপাশের বাজারে।রূপনা ফ্যাশনটি দুই যুগ আগে দিয়েছেন আবদুর রহিম। এখন এই ব্যবসা চালান তাঁর ছেলে মো. ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজ বলেন, এখান থেকে নগরের রেয়াজ উদ্দিন বাজারসহ বিভিন্ন মার্কেটে তৈরি পোশাক যায়। ছেলেদের প্যান্ট, শার্ট, টি-শার্ট, মেয়েদের থ্রি–পিস, ফ্রক, জিনস প্যান্ট সবকিছুই তৈরি হচ্ছে এখানে। মূলত পাইকারি বিক্রি হয় এখানে। পাইকারির পাশাপাশি খুচরাও বিক্রি হয়।
এসব পোশাক তৈরির কাঁচামালও মেলে একই জায়গায়। বোতাম, জরি, চুমকি, সুতাসহ নানা কাঁচামালের ব্যবসা চলে এখানে। ফেব্রিক কিনতে হয় টেরিবাজার কিংবা ঢাকা থেকে। খলিফাপট্টি বণিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমাম হোসেন বলেন, এবার নিত্যনতুন বেশ কয়েকটি পোশাক এসেছে। যার কারণে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জায়গা থেকে আসছেন। সারা রাত এখন ব্যবসা চলছে। কারখানাগুলোয় চলছে দিনরাত কাজ।