কক্সবাজারে বৃষ্টি থামায় নামতে শুরু করেছে বন্যার পানি। সদর উপজেলার কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা থাকলেও পাঁচ উপজেলার শতাধিক গ্রাম থেকে পানি নামছে বলে জানা গেছে। ঘরে পানি ওঠায় দুর্ভোগ বেড়েছে দুর্গত এলাকার মানুষজনের। প্রশাসন থেকে কিছু এলাকায় শুকনা খাবার পৌঁছালেও পানির কারণে অনেক বাড়িতেই চুলা জ্বলেনি।
জেলায় আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে ভারী বর্ষণ হচ্ছে না। টানা চার দিনের বর্ষণ ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে এখনো কক্সবাজার সদর, রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও চকরিয়া উপজেলার শতাধিক গ্রামের অন্তত ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছিলেন। এর মধ্যে কেবল টেকনাফের অন্তত ৫০টি গ্রামে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছিল। তবে ওই সব এলাকা থেকে এখন পানি নামছে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুল হান্নান বলেন, আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় কক্সবাজারে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৮৮ মিলিমিটার। এর মধ্যে সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ১১ মিলিমিটার। ৭ জুলাই বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছিল ১৫৭ এবং ৬ জুলাই ১৪৬ মিলিমিটার। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে। এর ফলে ভূমিধসেরও আশঙ্কা করছে আবহাওয়া বিভাগ।
এদিকে বাঁকখালী ও মাতামুহুরী নদীর পানি বঙ্গোপসাগরে নেমে যাওয়ায় চকরিয়া, পেকুয়া, রামু, কক্সবাজার সদর উপজেলার জলাবদ্ধতা কমে গেছে। ঘরবাড়ি থেকে বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও মানুষের দুর্ভোগ-ভোগান্তি কমছে না। বন্যার পানিতে এসব উপজেলায় অন্তত দুই হাজার ঘরবাড়ি নিমজ্জিত হয়েছিল।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, বৃষ্টিপাত কমায় পানি নামছে। ঘরবাড়ি থেকেও পানি সরে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে চাল ও শুকনা খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
টেকনাফে দুর্ভোগ-ভোগান্তি
গত চার দিনের ভারী বর্ষণে টেকনাফের পাঁচটি ইউনিয়নের অন্তত ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল। তাতে ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী ছিলেন। আজ সকাল থেকে বৃষ্টি কম হওয়ায় টেকনাফ পৌরসভার কলেজপাড়া, শীলবুনিয়াপাড়া, ডেইলপাড়া, জালিয়াপাড়া, খানকারডেইল, চৌধুরীপাড়া, কেকেপাড়া থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। অন্যদিকে হ্নীলা ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের জালিয়াপাড়া, সাইটপাড়া, ফুলের ডেইল, আলী আকবরপাড়া, রঙ্গিখালী লামার পাড়া, আলীখালী, চৌধুরীপাড়া, পূর্ব পানখালী, মৌলভীবাজার, লামার পাড়া, ওয়াব্রাং, সুলিশপাড়া ও পূর্ব সিকদারপাড়া থেকেও বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। পাহাড়ধসের ঝুঁকি থাকায় কয়েক শ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে এনেছে উপজেলা প্রশাসন।
টেকনাফের পুরান পল্লানপাড়ার মায়মুনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন দুই শতাধিক নারী-পুরুষ। তাঁদের একজন লায়লা খাতুন (৪৫) বলেন, ‘পাহাড়ধসের আশঙ্কায় চার সন্তান নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে এসেছি। এখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলেও নারীদের সমস্যা অনেক। বিভিন্ন বয়সের মানুষকে একসঙ্গে রাখায় নারীদের ভোগান্তি বাড়ছে।’
আরেক নারী ছমুদা বেগম (২৩) বলেন, নেটং পাহাড়ের ঢালুতে তাঁর বাড়ি। স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন চার বছর ধরে। ভারী বর্ষণ শুরু হলে আতঙ্ক বাড়ে। সন্তানদের কথা মাথায় রেখে ঘরবাড়ি ফেলে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন। এভাবে কত দিন থাকতে হয় জানা নেই।
গতকাল সোমবার রাত আটটার দিকে মায়মুনা বিদ্যালয় কেন্দ্রে আশ্রিতদের দেখতে যান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। ভারী বর্ষণে পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকা কারও জন্য নিরাপদ নয় জানিয়ে তিনি আশ্রিতদের বলেন, পাহাড়ে থেকে যাওয়া অন্য লোকজনকেও আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনতে হবে।
এ সময় সঙ্গে ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাকিবুল হাসান চৌধুরী। ইউএনও শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, পানিবন্দী ও পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে থাকা ২৫০ পরিবারকে ১৫ মেট্রিক টন চাল ও এক হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। পাহাড়ে থেকে লোকজনকে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে।
শহরের কিছু স্থানে জলাবদ্ধতা
সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে ডুবে ছিল কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সমিতিপাড়া, নাজিরারটেক, কুতুবদিয়াপাড়া, মোস্তাইক্যাপাড়া, ৩, ৬, ৭, ৯ ও ১২ নম্বর ওয়ার্ডে পাহাড়তলী, বৈদ্যঘোনা, রুমালিয়ারছড়া, তারাবনিয়ারছড়া, সৈকতপাড়া, আদর্শগ্রাম, কলাতলীসহ ১০-১২টি গ্রামের দুই হাজার ঘরবাড়ি। আজ বেলা দুইটা পর্যন্ত ভারী বর্ষণ না হওয়ায় কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা কমেছে।
তবে শহরের সৈকত সড়কের সুগন্ধা এলাকায় কিছু অংশ, হোটেল মোটেল জোনের অভ্যন্তরীণ চারটি সড়ক এবং প্রধান সড়কের কালুর দোকান, টেকপাড়া, তারাবনিয়ারছড়া, রুমালিয়ারছড়ার কয়েকটি অংশে জলাবদ্ধতা রয়েছে এখনো। তাতে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। বিশেষ করে পাহাড় কাটার মাটির ঢলের পানিতে মিশে শহরের রাস্তা ও নালা ঢেকে দিয়েছে।
কক্সবাজার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেদী মোর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি প্রধান সড়কের দুই পাশের কয়েক কিলোমিটার নালা পরিষ্কার করা হয়েছিল। কিন্তু পাহাড় কাটার মাটি নেমে এসে তা আবার ভরাট হচ্ছে। শহরের জলাবদ্ধতা দূর করতে হলে পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে।
(তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন টেকনাফ ও চকরিয়া প্রতিনিধি)