‘এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, ভাই বেঁচে নেই। দুই দিন ধরে ঘুম হয়নি। ঈদের ছুটিতে বন্ধুরা মিলে কক্সবাজার গিয়েছিলেন। তাঁরা বন্ধু, আবার আত্মীয়ও। কিন্তু কীভাবে কী হয়ে গেল, জানি না। রাজীবের স্ত্রী আর আমাদের মা এখন কথা বলতে পারছেন না। আপনারা আমার ভাইয়ের জন্য দোয়া করবেন। আমার ভাইয়ের পরিবারের দেখাশোনা এখন আমরাই করব।’
মলিন মুখে কথাগুলো বলছিলেন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ডুবে মৃত্যু হওয়া মো. রাজীব আহমেদের (৩৩) বড় ভাই মো. সুলতান আহমেদ। আজ মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের পশ্চিম বাকলিয়া ডিসি রোড এলাকায় মদিনা মসজিদের সামনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। মসজিদের পাশের কবরস্থানেই রাজীবের দাফন করা হয়েছে।
রাজীব নগরের পশ্চিম বাকলিয়া ডিসি রোড ভরা পুকুরপাড় মেম্বার গলির মৃত নজির আহমেদের ছেলে। তিনি আন্দরকিল্লা এলাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতেন। চার ভাইয়ের মধ্যে রাজীব ছিলেন তৃতীয়। তাঁর বড় ভাই সুলতান আহমেদ ঠিকাদারির কাজ করেন। ভাইয়ের মৃত্যু কিছুতেই মানতে পারছেন না তিনি।
সুলতান আহমেদ বলেন, ‘কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়া পাঁচজনের মধ্যে একজন রাজীবের সম্বন্ধী। অন্যরাও চাচাতো–জ্যাঠাতো ভাই। একই বাড়ির ছেলে সবাই। কেউ ঢাকায় থাকেন, কেউ অন্য জেলায়। ঈদের আগে থেকে পরিকল্পনা করায় ঘুরতে গিয়েছিলেন। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল। আমাকে ফেলে রাজীব ভাতও খেতেন না। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না, রাজীব নেই।’
বাক্রুদ্ধ মা ও স্ত্রী
মূল সড়কের পাশ দিয়ে সরু গলি। গলির শেষ মাথায় নারীদের জটলা। সবার মুখেই শোকের ছাপ। তাঁদের কেউ রাজীবের চাচি, কেউ ভাবি আবার কেউ চাচাতো ভাই। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই দেখিয়ে দিলেন রাজীবের ঘর। স্থানীয় একজন একটি আধা পাকা ঘরের সামনে নিয়ে গেলেন। লম্বাটে ঘরটিতেই তিন ভাই, মা ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন রাজীব।
কয়েকজন এসে পরিচয় জানতে চেয়ে অপেক্ষা করতে বললেন। রাজীবের স্ত্রী ও চার বছর বয়সী ছেলে ভেতরের ঘরে ছিল। কথা বলতে চাইলে পরিবারের সদস্যরা জানালেন, তিনি কথা বলতে পারছেন না। রাজীবের মা শামীমা বেগমও এখন বাক্রুদ্ধ। রাজীবের চাচি পরিচয়ে একজন জানান, তাঁদের শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। কথা বলতে পারছেন না।
আজ বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে সেখানে গেলে স্থানীয় লোকজন জানান, রাজীব পরিবারের সবারই খুব প্রিয় ছিলেন। চাচাতো ভাইয়েরাও খুব পছন্দ করতেন তাঁকে। উৎসবের সময় সবাই একসঙ্গে আনন্দ করতেন। পাঁচ বছর আগে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলেন তিনি। তাঁদের সংসারে চার বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে। তাঁর বাড়ির এক ঘর পরেই শ্বশুরবাড়ি। সেখানে গিয়েও কাউকে পাওয়া যায়নি।
রাজীবের পরিবার ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ১৭ বছর আগে রাজীবের বাবা নজির আহমেদ মারা যান। তাঁদের পৈতৃক নিবাস এখানেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে রাজীবের ভালো সম্পর্ক ছিল। সবার সঙ্গে বিনয়ী আচরণ করতেন তিনি। কারও সঙ্গে বৈরিতা ছিল না তাঁর। এমন মানুষের চলে যাওয়ায় এলাকাবাসীও শোকাহত।
ঘটনা যা হয়েছিল
গত রোববার বিকেল চারটার দিকে পাঁচ বন্ধু ও স্বজনের সঙ্গে সৈকতের লাবণী পয়েন্টে গোসলে নামেন রাজীব। হঠাৎ এক বন্ধু স্রোতের টানে ভেসে যেতে থাকলে তাঁকে উদ্ধারে এগিয়ে যান তিনি। এরপর তিনিও স্রোতে তলিয়ে যান। দীর্ঘ সময় খোঁজাখুঁজির পর দিবাগত রাত ১২টার দিকে সৈকতের কবিতা চত্বর পয়েন্টে (লাবণী পয়েন্টের আধা কিলোমিটার উত্তরে) রাজীবের মরদেহ ভেসে ওঠে।
জেলা প্রশাসনের বিচের কর্মী মাহবুব আলম বলেন, রোববার বিকেলে রাজীবসহ পাঁচ বন্ধু সাগরের পানিতে গোসল করতে নামেন। এক বন্ধু স্রোতে ভেসে যেতে থাকলে রাজীব তাঁকে বাঁচাতে ছুটে যান। ধারণা করা হচ্ছে যে রাজীব সৈকতের নিচে সৃষ্ট গুপ্ত খালে আটকা পড়েছিলেন।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইলিয়াস খান বলেন, বঙ্গোপসাগর উত্তাল রয়েছে। সতর্কতা হিসেবে সৈকতে লাল পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অনেকেই গোসলে নেমে বিপদে পড়ছেন। রাজীবের মরদেহ উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। আইনিপ্রক্রিয়া শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
ঈদের ছুটির দুই দিনে সাগরে নেমে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ভ্রমণে আসা পর্যটকসহ ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সৈকতের একাধিক স্থানে ভাঙন ও গুপ্ত খালের সৃষ্টি হওয়ায় সাগরে নামার আগে বিপদ টের পাচ্ছেন না পর্যটকেরা। পর্যটকদের উদ্ধারের আয়োজনও অপ্রতুল। ফলে সমুদ্রস্নানে যাওয়া পর্যটকদের মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।