বেদেপল্লিতে ভোট চাইতে আসেননি কেউ

বেদেপল্লির বাসিন্দা দিতি বেগম ও রিপন সরদারদের বসতঘর নেই। প্লাস্টিকের ছাপরার মধ্যেই থাকতে হয়। শরীয়তপুর সদর উপজেলার চরডোমসার এলাকায় গত রোববারছবি: প্রথম আলো

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর কয়েক দিন। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন প্রার্থীরা। দিনভর চলছে মাইকিং। পোস্টারে ছেয়ে গেছে চারপাশ। কিন্তু কীর্তিনাশা নদীর তীরের বেদেপল্লিতে প্রবেশ করলে তেমন কিছু চোখে পড়ে না। এমনকি একটি পোস্টারও লাগানো হয়নি ৪০০ ভোটারের ওই পল্লিতে। প্রচারণার ১২ দিন পেরিয়ে গেলেও কোনো প্রার্থী ভোট চাইতে আসেননি।

শরীয়তপুর-১ (সদর এবং জাজিরা) আসনের সদর উপজেলার ডোমসার ইউনিয়নের চরডোমসার এলাকায় বেদেপল্লি অবস্থিত। জেলা শহর লাগোয়া কীর্তিনাশা নদীর তীরে ১৯৯০ সালে তাঁরা এ বসতি গড়ে। গত রোববার বেদেপল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, নৌকায় কীর্তিনাশ নদী পারাপার হয়ে যাতায়াত করছেন পল্লির বাসিন্দারা। সরাসরি যাতায়াতের কোনো রাস্তা নেই। মানুষের জমি ও নদীর তীর ধরে হেঁটে বেদেপল্লি থেকে বের হতে হয়। বেদেপল্লির বাসিন্দারা স্থায়ী শৌচাগার ব্যবহার করেন না। সিমেন্টের স্ল্যাব দিয়ে নির্মাণ করা অস্থায়ী শৌচাগার ব্যবহার করছেন তাঁরা। পুরো পল্লিতে দুটি পানির নলকূপ রয়েছে। অনেকের বসবাস করার ঘর না থাকায় বাঁশ ও প্লাস্টিক দিয়ে ছাপরা নির্মাণ করে বসবাস করছেন।

দেশে নির্বাচন আইছে। কে কোন মার্কায় দাঁড়াইছে, তা–ও জানি না। কাউরে চিনি না। এই এলাকার এমপিরেও দেহি নাই।
কালু সরদার, বেদেপল্লির বাসিন্দা

রোববার বেদেপল্লির বাসিন্দারা বলেন, তাঁদের আদি নিবাস মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলায়। সেখানে নদীভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে তাঁরা চরডোমসার এলাকায় জমি কিনে ১৯৯০ সালের দিকে বসতি গড়েন। বর্তমানে বেদেপল্লিতে ১৫৫টি পরিবার বসবাস করে। ওই পরিবারগুলোতে অন্তত ৪০০ ভোটার রয়েছে। তাঁদের অনেকের নেই থাকার ঘর, অনেকের জমি–ঘর কিছুই নেই। পল্লির ভূমিহীন ২৩ জন জমি ও ঘর পেতে সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছেন।

বেদেপল্লির ৭০ জন শিশু পাশের ডোমসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। পল্লি থেকে বিদ্যালয়টির দূরত্ব দেড় কিলোমিটার। নৌকায় কীর্তিনাশা নদী পারাপার হয়ে শিশুদের বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে হয়। দূরত্ব ও যাতায়াতে কষ্ট ভেবে অনেক শিশুকে বিদ্যালয়ে পাঠানো হয় না।

বেদেপল্লির বাসিন্দা কালু সরদারের বয়স ৬৬ বছর। ১৯৯০ সাল থেকে তিনি শরীয়তপুরের বাসিন্দা। অনেক কষ্টে ২ শতাংশ জমি কিনতে পারলেও তাতে ঘর তুলতে পারেননি। স্ত্রী ছুরিনা খাতুনকে নিয়ে একটি ছাপরায় থাকেন। কালু সরদার বলেন, ‘ভোট আসে, তাই ভোট দিতে যাই। কিন্তু আমাদের ভাগ্যের আর কোনো পরিবর্তন হয় না। আমরা এমন বঞ্চিত মানুষ, কেউ খোঁজ নেয় না। দেশে নির্বাচন আইছে। কে কোন মার্কায় দাঁড়াইছে, তা–ও জানি না। কাউরে (প্রার্থীকে) চিনি না। এই এলাকার এমপিরেও কোনো দিন দেহি নাই।’

নদীর তীরে প্লাস্টিকের ছাপরার মধ্যে থাকেন। শীতে-বৃষ্টিতে অনেক কষ্ট হয়। কেউ খোঁজ নেন না। কেউ কি নেই, পাশে দাঁড়াবেন?
দিতি বেগম, বেদেপল্লির বাসিন্দা

দিতি বেগমের বয়স ২২ বছর। নতুন ভোটার হিসেবে এ বছরই তিনি প্রথম ভোট দেবেন। তিনি বলেন, চরডোমসারের বেদেপল্লিতে জন্ম তাঁর। এখানেই বেড়ে উঠেছেন। শিশু বয়স থেকে বঞ্চনা, অভাব আর দারিদ্র্য দেখেছেন। স্বামী লিটন সরদার আর এক শিশুসন্তানকে নিয়ে নদীর তীরে প্লাস্টিকের ছাপরার মধ্যে থাকেন। শীতে-বৃষ্টিতে অনেক কষ্ট হয়। কেউ খোঁজ নেন না। কেউ কী নেই, যিনি তাঁদের কষ্ট দূর করবেন, পাশে দাঁড়াবেন?

ডোমসার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, নানা কারণে বেদেপল্লিতে আশ্রয়ণের কোনো ঘর নির্মাণ করে দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বিভিন্ন ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ওই পল্লির অন্তত ৪০ জনকে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে।

জাতীয় পার্টির প্রার্থী মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমি নির্বাচনে বিজয়ী হলে বেদে সম্প্রদায়ের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করব। তাঁদের সন্তানদের পড়ালেখা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেব।’

আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন বলেন, বেদে সম্প্রদায়সহ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য আওয়ামী লীগ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি শিগগিরই বেদেপল্লিতে যাবেন। সেখানে তাঁদের নেতা-কর্মীরা বেদে সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।