ময়মনসিংহ নগরের একটি কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী সাদেক (ছদ্মনাম)। ছয় মাস আগে শনাক্ত হয়, তিনি এইচআইভি পজিটিভ। দীর্ঘদিন ধরে শরীরের চুলকানি ভালো না হওয়ায় চিকিৎসক দেখাতে গিয়ে পরীক্ষায় ধরা পড়ে তিনি এইডসে আক্রান্ত। তিনি বলেন, ২০২০ সালে গাজীপুরে একটি ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করতেন। সেখানে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাঁর শারীরিক সম্পর্ক হয়। পরের বছর ময়মনসিংহ শহরে মেসে থেকে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। তখন রুমমেটের সঙ্গে একই ধরনের সম্পর্কে জড়ান। ফেসবুক ও অ্যাপের মাধ্যমে এমন বন্ধু খুঁজে সম্পর্ক করেন।
শুধু এই তরুণ নন, ময়মনসিংহ বিভাগে গত চার বছরের বেশি সময়ে ৫৪ জনের এইডস শনাক্ত হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে যাত্রা শুরু করা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এইচআইভি টেস্টিং সার্ভিস (এইচটিসি) সেন্টারের তথ্য এটি। এখানে বিনা মূল্যে এইচআইভি পরীক্ষা করা যায়। এখানকার তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোট ১১ হাজার ১৮ জনের পরীক্ষা করে ৫৪ জন এইচআইভি পজিটিভ পাওয়া যায়। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে দুজনের মৃত্যু হয়। ৫৪ জনের মধ্যে ৫০ জন পুরুষ। এর মধ্যে সমকামী ৩৯ জন, যা মোট শনাক্ত পুরুষের ৭৮ শতাংশ। তাঁদের বেশির ভাগই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এইচআইভি ইউনিটের ফোকাল পারসন ফরহাদ হোসেন হীরা বলেন, এইডসে আক্রান্ত পুরুষদের অধিকাংশই সমকামী। বিষয়টি খুবই উদ্বেগের। তরুণদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে এ ধরনের প্রবণতা বাড়ছে। পরিবারের বাইরে মেস বা হোস্টেলে থাকা যুবকেরা এসবে বেশি জড়াচ্ছেন। এ থেকে উত্তরণে সামাজিক সচেতনতা জরুরি।
হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মে মাসে ময়মনসিংহের একটি উপজেলার এক পরিবারের স্বামী, স্ত্রী ও তাঁদের তিন শিশুসন্তানের এইডস শনাক্ত হয়। গৃহকর্তার মাধ্যমে এটি অন্যদের মধ্যে ছড়ায়। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৩১ জনের এইডস শনাক্ত হয়। তাঁদের মধ্যে ২৭ জনই পুরুষ, বয়স ১৯ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এ সময়ে ২ হাজার ৬০১ জনের এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়।
এইচটিসি সেন্টারের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এইডস শনাক্ত হয়েছে ১৪ জনের। এর মধ্যে ৪৮ বছরের একজন নারী, অন্যরা সবাই পুরুষ। তাঁদের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছর। এ সময়ে পরীক্ষা করা হয় ৩ হাজার ২৯৬ জনের। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১০ জনের শরীরে এইডস শনাক্ত হয়। ওই বছর পরীক্ষা করা হয় ১ হাজার ৭২৯ জনের। এইডস শনাক্ত হওয়া ১০ জনের সবাই পুরুষ। ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত একজনের এইডস শনাক্ত হয়। সে বছর ২ হাজার ৩৯২ জনের পরীক্ষা করা হয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত একজনের শরীরে এইডস ধরা পড়ে। ওই বছর এক হাজার ব্যক্তির পরীক্ষা করা হয়।
হাসপাতালের এইচটিসি সেন্টারের কাউন্সিলর কাম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মো. আবদুল আল মামুন বলেন, এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই সমকামী পুরুষ। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। তাঁদের বেশির ভাগই মেসে থেকে পড়াশোনা করেন। তাঁরা কাউন্সেলিং করছেন, তবে সমাজে আরও সচেতনতা বাড়ানো দরকার।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এই কর্মকর্তা বলেন, এইচআইভি সংক্রমণের বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটে অরক্ষিত যৌন মিলনের কারণে। মানবদেহের কয়েকটি নির্দিষ্ট তরল পদার্থের (রক্ত, বীর্য, বুকের দুধ) আদান-প্রদানের মাধ্যমে এটি ছড়াতে পারে। অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক, একই সুই-সিরিঞ্জ ব্যবহার করে মাদক সেবন, অপরীক্ষিত রক্ত গ্রহণ, এইচআইভিতে আক্রান্ত মা–বাবার কাছ থেকে শিশুর শরীরে এইডসের জীবাণু যায়।
নাগরিক সংগঠন ময়মনসিংহ ফোরামের তত্ত্বাবধায়ক সাঈদ ইসলাম বলেন, বিশ্বায়ন যেমন বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, তেমনি সমাজে যুক্ত করেছে নানা অস্বস্তিকর অনুষঙ্গ। ময়মনসিংহে গত কয়েক বছরের এইচআইভিতে আক্রান্ত রোগীর পরিসংখ্যান শঙ্কিত করে তুলছে। ধর্মীয় অনুশাসনের পাশাপাশি সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধন ও দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা এ সমস্যা অনেকটা রোধ করতে পারে। এ ছাড়া সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।