কালুহাটিতে হাতে তৈরি জুতার কারখানায় ব্যস্ত সবাই

কারখানায় চলছে জুতা তৈরির কাজ। বৃহস্পতিবার রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার কালুহাটি গ্রামেছবি: প্রথম আলো

বড়াল নদের ঠিক পাড়েই কালুহাটি গ্রাম। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার এই গ্রামে ঢুকতেই এখানে-ওখানে চোখে পড়ে বিভিন্ন পাদুকা কোম্পানির নানা বিজ্ঞাপন। গ্রামের একটু ভেতরে গেলেই বাড়িতে বাড়িতে জুতার কারখানার সাইনবোর্ড দেখা যায়। ঈদ ঘিরে পাদুকাপল্লি খ্যাত কালুহাটি গ্রামে হাতে তৈরি জুতা বানানোর কাজ জোরেশোরে চলছে।

মূলত হাতে তৈরি জুতার জন্যই কালুহাটি সুপরিচিত। তবে গত বছর আগস্টে এই গ্রামে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে দেশে প্রথমবারের মতো পাদুকাশিল্পে ক্লাস্টারভিত্তিক কমন ফ্যাসিলিটি সেন্টারের (সিএফসি) উদ্বোধন করা হয়েছে। যন্ত্রের সহায়তায় উন্নত মানের জুতা তৈরি করা যাচ্ছে। উদ্যোক্তারা হাতে তৈরি জুতার পাশাপাশি যন্ত্রের সহায়তাও নিচ্ছেন।

ব্যবসায়ী ও কারিগরেরা জানান, কালুহাটিতে একসময় বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকার ব্যবসা হতো। করোনার আগপর্যন্ত জুতার ৭৫টি কারখানা ছিল গ্রামটিতে। এখন টিকে আছে অর্ধেকের কম। এর মধ্যে কিছু কারখানা চালু থাকলেও সেগুলো ঈদ সামনে রেখেই কাজের গতি বাড়িয়ে দেয়। মূলত করোনার সময় থেকেই ব্যবসায়ে ভাটা পড়েছে, কারখানাও কমেছে। এমনকি করোনার পর কয়েকটা ঈদ পাড়ি দিলেও বিভিন্ন জায়গার পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা তেমন আসেননি। তবে চলতি মৌসুমে দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতারা আসছেন। ঈদেও কাছাকাছি সময়ে তা আরও বাড়তে পারে।

গত বৃহস্পতিবার কালুহাটি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কারখানাগুলোতে ঠুকঠাক শব্দ হচ্ছে। শ্রমিকেরা একই ঘরের ভেতরে বসে একেকজন একেক কাজ করছেন। কেউ জুতার মাপে চামড়া কাটছেন, কেউবা তাতে সেলাইয়ের পর আঠা দিয়ে দিচ্ছেন, কেউ সুন্দর নকশা ও জুতোর নামফলক বসাচ্ছেন।

গ্রামে বসতবাড়ির পাশেই তৈরি করা হয়েছে জুতার কারখানা
ছবি: প্রথম আলো

‘রাজ সুজ’ নামের জুতার কারখানায় গিয়ে দেখা গেল বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ, শিশুদের জুতো তৈরি করে ক্রেতার আকর্ষণের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। জুতার দাম ৯০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। কারখানার মালিক রাজীব আলী বলেন, ২০১৪ সালের দিকে নিজের বাড়িতে জুতা তৈরির কারখানা খোলেন। করোনার আগে জুতার জন্য ক্রেতারা এসে বসে থাকত লাইন ধরে। এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। করোনার পরপরই বাজার সয়লাব হয়ে গেছে বিদেশি জুতায়। যদি মানুষ দেশি পণ্য কেনে, তাহলে তাঁরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। তবে এ বছর আগের বছরগুলোর চেয়ে ভালো পরিস্থিতি।

এই কারখানা থেকে একটু দূরেই ‘বিজয় সুজ’ কারখানা। সেখানে ৩০ জন শ্রমিক বিভিন্ন কাজ করছেন। এখানে কাজ করছিলেন কলেজছাত্র সাগর আহমেদ। তিনি বলেন, সারা বছরই কারখানায় লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজ করেন। কলেজে না গেলে সারা দিন, আর গেলে দিনে ও রাতের একটি সময় কাজ করেন। দৈনিক ৪০০-৫০০ টাকা আয় হয়। তিনি চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। যত কাজ তত টাকা।

অনেক কারখানায় জুতা প্রদর্শন (ডিসপ্লে) করা হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

অন্য কারখানার তুলনায় বিজয় সুজ বেশ সাজানো–গোছানো। চামড়ার জুতার পাশাপাশি আরও বিভিন্ন ক্যাটাগরির জুতা প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। এই কারখানার মালিক সোহেল রানা। তবে তিনি তখন ছিলেন না। তাঁর ছোট ভাই রাফিউল ইসলাম বলেন, এ বছর ব্যবসা ভালো। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রেতা আসছেন। তাঁদের কারখানা থেকে কোনো ক্রেতা ফেরত যান না। কারণ, সব ধরনের জুতা আছে। বানানো জুতা শেষ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত।

এই রকম চিত্র দেখা গেল ‘পায়ে পায়ে সুজ’, ‘শ্রাবণী সুজ’সহ বেশ কয়েকটি কারখানায় গিয়ে। তাঁরা ঈদ সামনে রেখেই বেশি করে জুতা তৈরি করেছেন। সারা বছর খুব বেশি জুতার চাহিদা ছিল না। অনেক জুতার কারখানা বছরের বেশি সময় বন্ধ থাকে। শ্রাবণী সুজ কারখানার মালিক ইসরাইল প্রামাণিক বলেন, তাঁরা ঈদ সামনে রেখেই কাজ করেন। সারা বছর ক্রেতা কম। আগের মতো ব্যবসা নেই।

এবার আগের চেয়ে পরিস্থিতি অনেকটা ভালো মনে হচ্ছে। জুতার অনেক অর্ডার আসছে। কিন্তু ঢাকা থেকে চাহিদামতো কাঁচামাল পাচ্ছি না।
সোহেল রানা, সাধারণ সম্পাদক, কালুহাটি পাদুকা সমবায় সমিতি

পায়ে পায়ে সুজের মালিক জয়নাল আবেদীনও একই সুরে কথা বললেন। তবে তাঁর কারখানার শ্রমিক বাঁধন আহমেদ বললেন, বিদেশি পণ্য বয়কটের কথা শুনছেন। মানুষজন যদি দেশি পণ্য কেনেন। তাহলে তাঁরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।

কণিকা সুজের মালিক ও কালুহাটি পাদুকা সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা বলেন, এবার আগের চেয়ে পরিস্থিতি অনেকটা ভালো মনে হচ্ছে। জুতার অনেক অর্ডার আসছে। কিন্তু ঢাকা থেকে চাহিদামতো কাঁচামাল পাচ্ছেন না। আরও দু-চার দিন গেলে বোঝা যাবে তাঁরা কী রকম ব্যবসা এবার করতে পারবেন।

সোহেল রানা আরও বলেন, গত বছর আগস্টে এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ক্লাস্টারভিত্তিক ‘সিএফসি’ চালু করা হয়েছে। এখন সহজে ভালো ফিনিশিংয়ের জুতা তৈরি করা যাচ্ছে। এখন তাঁরা সব ধরনের জুতা তৈরি করতে পারবেন।